‘সব জননীই সন্তানের চোখে অপরূপা নারী’

আমার বাবা মা আট সন্তানের জনক জননী। আম্মার কাছে প্রায়ই আব্বার গল্প শুনি। তাঁর বর্ণনামতে আমার বাবা ছিলেন ষাটের দশকের হ্যান্ডসাম নায়কদের মত। রঙ্গিন চশমা পরে বাইরে ঘুরতে যেতেন। পুরনো ছবি দেখে অনেক সময় মনে হত ফিরোজ খান রাজেন্দ্র কুমার দিলীপ কুমার শশী কাপুর বিশ্বজিতদের মত। আম্মার বিয়ে হয়েছে খুব অল্প বয়সে। বিয়ের দিন আব্বাকে প্রথম দেখে আম্মার নাকি মূর্ছা যাওয়ার দশা হয়েছিল। বাস্তবে নিজের চোখে এমন সুদর্শন পুরুষ আম্মা কখনো দেখেননি। এছাড়া আমার নানাজী ছিলেন প্রচন্ড ধার্মিক একজন ব্যক্তি। আম্মা যখন প্রাইমারি স্কুলে তখন আমার আব্বার পরিবার থেকে নানাজীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব যায়। আমার খালার কাছে সেই গল্প শুনেছি। আব্বার গায়ের রঙ দেখে সবাই একে অন্যের সাথে চোখাচোখি করছিল। টসটসে লাল আপেলের মত ছিল আব্বার গায়ের রঙ। আম্মার বড় বুজান (বড় ভাইদের স্ত্রীকে উনারা বুজান বলে সম্বোধন করতেন। আব্বার স্মার্টনেসের কাছে আম্মা মারাত্মক নার্ভাস ছিলেন। কিন্তু আব্বা তাঁর প্রেম প্রীতি সহমর্মিতা দিয়ে আম্মার সব জড়তা দূর করে দিয়েছিলেন। বিয়ের সময় আব্বা ছিলেন কলেজের ছাত্র। অত্যন্ত মেধাবী করে আল্লাহ পাক আমার বাবাকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আমার আম্মা নববধূ হিসেবে শ্বশুরালয়ে পা রাখার পর এক বীতশ্রদ্ধ অনুভূতির স্বাদ পেয়েছেন। আব্বারা তিন ভাই দুই বোন। ভাইদের মধ্যে আব্বা সবার ছোট। বলে রাখা দরকার আমার দাদাজান পন্ডিত ছিলেন। পন্ডিত সুজাত আলী অত্র এলাকার সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। দাদীজান ছিলেন স্কুল মাস্টারনী। ওই যুগে চার চোখের মিলনে পন্ডিত সুজ্জাত আলী ও জাহেদা খাতুনের মধ্যে মনের ভাব বিনিময় হয়। দাদাজান দাদীজানের প্রেমকাহিনী শুনে অবাক হলাম না এই কারণে, মুসলিম জাতির প্রেমের গুরু – গুরুমাতা তো আদম হাওয়াই। আমার নববধূ মায়ের কোমরে নেমে যাওয়া লম্বা চুলে টার্সেল দিয়ে বেণীগাঁথা চুলের বেণী খুলবার আগেই আব্বার বড়ভাবী আমার মায়ের পরণে থাকা উনার লাল রঙিন শাড়ি খুলে নেয়ার তাগাদা দিলেন। জেঠিমার দামী শাড়ি পরে আম্মাকে নববধূ করে শ্বশুরগৃহে তুলে আনা হয়। নাক উঁচা ও দম্ভ দেখাতে অভ্যস্ত জেঠিমার এমন অমানবিক আচরণ আম্মা তাঁর সন্তানদের সাথে বহুবার শেয়ার করেছেন। যে কষ্ট মনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতের সৃষ্টি করে, সেটা মনে হয় আমৃত্যু মানুষের মনে গেঁথে থাকে। বুঝলাম আমাদের মায়ের এই বেদনা যন্ত্রণা অমরত্ব লাভ করেছে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আজ আমার চার ভাই সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা দেখলে বোন হিসেবে আমরা গর্ব করার অধিকার রাখি। আব্বার চাকরী হবার পর প্রথম মাসের বেতন দিয়ে আম্মার জন্য সুন্দর সুন্দর দামী সব শাড়ি কিনে এনেছিলেন আব্বা। আর আম্মার সন্তানরা তাদের মা’কে বেনারসি কাতান সাউথ কাতান গাদোয়াল শাড়ি কিনে আলমিরা ভরিয়ে দিয়েছে। শাড়ি গয়নার অভাব নাই আমার আম্মার। কিন্তু এখন তিনি একরকম শিশুই। সবার মনোযোগ আশা করেন।

Post MIddle

এক সময় আমার মায়ের খুব বই পড়ার অভ্যাস ছিল।পথের পাঁচালী পদ্মানদীর মাঝি মেজদিদি লালসালু বড়দিদি বহ্নিশিখা বউ ঠাকুরানীর হাট, চোখের বালি, রাজর্ষি, দুইবোন, নৌকাডুবি, চার অধ্যায়, পুতুল নাচের ইতিকথা, হলুদ পোড়া, গৃহদাহ, চন্দ্রনাথ, চিলেকোঠার সেপাই, ইত্যাদি বইয়ের কথা খুব মনে আছে। সংসারের কাজ শেষ করে এসব বই পড়তে বসে যেতেন আম্মা। আমার সেজোভাই কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের বিশাল সংগ্রহকারী। দাদার সংগ্রহে এত এত মাসুদ রানা সিরিজের বই দেখতাম, মনে হত সেজদা নিজেই একটা চলমান লাইব্রেরী। আমি অনেক বার লুকিয়ে ছুপিয়ে মাসুদ রানা পড়তাম। কায়রো, শত্রু ভয়ংকর, অকস্মাৎ সীমান্ত, বিষকন্যা, ভারত নাট্যম, রানা সাবধান, স্বর্ণমৃগ, শয়তানের দুত, ক্ষ্যাপা নর্তক, পিশাচ দ্বীপ, বিদেশী গুপ্তচর এসব বইয়ের নাম ও ঘটনা আজো ভুলতে পারি না। অপ্রাপ্ত বয়সে মাসুদ রানার দুর্ধর্ষ সিরিজ পড়া নিষেধ জানতাম। পরিবার থেকেও কড়া নিয়ম ছিল। কিন্তু চুরি করে বই পড়ার মধ্যে যে থ্রিল পাওয়া যায়, সেটা অনেকে বুঝবেনা।

আব্বা প্রায় বলতেন, মালেকাকে ( আম্মার নাম) প্রথম দেখার পর মনে হল মোঘল আমলের সম্রাজ্ঞী। তাঁর চলন বলন ব্যক্তিত্ব সবকিছুই মোঘল আমলের রাণীদের মত তীব্র আভিজাত্যপূর্ণ। বুঝ–বুদ্ধি হবার পর থেকে দেখেছি আব্বার দেয়া উপাধি ভুল ছিল না। আমাদের জননী সম্রাজ্ঞী মালেকা বেগমে প্রখর বুদ্ধি তেজোদীপ্ত আচার আচরণে মনে হত ভারতবর্ষের আলোড়ন সৃষ্টিকারী সুলতানা রাজিয়া। আম্মার ভয়ে অনেকের মুখের ভাষা হারিয়ে যেত। না, এই ভয়ের মানে এই নয় যে, আমার মা দয়ামায়াহীন। অসামান্য মমতা তেজি ব্যক্তিত্বের কারণে অনেকে আম্মার সামনে নার্ভাস হয়ে পড়ত। এমনকি আমার সহপাঠীরা বলত — খালাম্মার সামনে গেলে গলা শুকিয়ে যায়। ওরা বাসায় এলে আম্মা অতি মমতার সাথে ওদের সাথে কথা বলতেন।খাবার খেতে দিতেন। তাদের পড়াশুনার খবর নিতেন।

আম্মার সাথে ভিডিওতে কথা বলি, নিজের মনে নিজেই ময়ূরপঙ্খিতে উড়ে বেড়াই। আমার মা আজো অপরূপা। আসলে সব সন্তানের চোখে তাদের জননী পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। আমাদের মায়ের মত অপরূপা কোন বোনই হয়নি। আমাদের আট ভাইবোনের সেই বিদুষী জননী। আমার জীবনে আমাদের মায়ের মত সমাজ সচেতন রাজনীতি সচেতন নারী আমি দেখিনি। একজন সাধারণ গৃহিণী এত জ্ঞান ধারণ করতে জানেন, ভাবলে অবাক হই। আমার এক শ্রদ্ধেয় বড়ভাই আম্মার সমাজ সচেতনতা দেখে তাঁকে “মতিয়া চৌধুরী” আখ্যা দিয়েছেন। এর যৌক্তিক কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টো, ভুট্টো পত্নী নুসরাত ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, জিয়াউল হক, ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, জওহরলাল নেহেরু, জিয়াউর রহমান, এবং রাজীব গান্ধী সবার কর্মকান্ড আম্মার ব্রেন সেন্টারে ইনস্টলড করা ছিল। অনেকে জানতে চাইত আম্মা রাজনীতির সাথে জড়িত কিনা। আর আজ আমাদের সেই মা রাজনীতি সমাজনীতি দেশনীতি কোন বিষয়ে আর আগ্রহ দেখান না। প্রবাসে তাঁর সন্তান নাতি নাতনিদের নিয়ে বিচলিত থাকেন। অনেক সময় মনে হয়, বাংলাদেশে আছেন আম্মা।দেশের সন্তান নাতি নাতনিরা আম্মাকে ইচ্ছা করলেই যখন তখন দেখতে যেতে পারে। পারিনা আমরা পরদেশে বাস করি যারা। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে কাতরোক্তি করেন, মিলন (আব্বা আম্মার কাছে আমি তাঁদের আদরের মিলন) দেশে মায়ের কাছে চলে আয়। নিজের দেশের মাটিয়ে খালি পায়ে হাঁটলে সুস্থ হয়ে যাবি। দৃষ্টিশক্তি আগের মত প্রখর নেই। তবুও ভিডিওতে যখন আমাদেরকে দেখেন, চোখ বড় করে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থেকে বলে উঠেন, “কি রে তোর চেহারা- ছবি এমন শুকনা শুকনা লাগে কেন? খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করিস তো?”

আম্মার ছলছল চোখ দেখে ভিডিও ক্যামেরা থেকে মুখ অন্যদিকে চট করে সরিয়ে ফেলি। এমন বুকভাঙ্গা কান্না এড়ানো কার সাধ্য আছে? কবি নজরুলের মাকে নিয়ে রচিত গানের কথাগুলো বুকে কষ্টের ডমরু বাজায়।

“তার মায়ায় ভরা সজল বীথি
সেকি কভু হারায়
সে যে জড়িয়ে আছে
ছড়িয়ে আচ্ছে
সন্ধ্যা রাতের তারায়
সেই যে আমার মা ।।
বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা”

পছন্দের আরো পোস্ট