একুশে বইমেলা – বাঙালির চেতনার শেকড়

ঋতুরাজ বসন্তের আগমনীতে বাংলা একাডেমী, সোহয়ার্দী উদ্যানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছে গাছে পুরানো হলদে পাতা ঝড়ে নতুন সবুজের সমারোহ । বসন্তের মাতাল সমীরণ বইতে না বইতেই টকটকে লাল বর্ণচ্ছটায় মন রাঙ্গানো শিমুল-পলাশ প্রকৃতিতে এনে দেয় নতুন মাত্রা। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিবোধ ও ঐতিহ্যেগড়া শুরু হয় মাসব্যাপী একুশে বইমেলা । একুশে বইমেলা বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনার শেকড় । এ এক বাঙালি সত্তার ইতিবৃত্ত । মূলত: বাংলা সাহিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটেছে এই বইমেলাকে ঘিরেই ।

বই হচ্ছে পবিত্র এক আলোক দীপ্তি । যার আলোয় আমাদের চারপাশ আলোকিত হয়। পবিত্র হয় মন। দূর করে অন্ধকার । আত্মাকে করে শুদ্ধ, শুভ্র ও পরিতৃপ্ত । বইয়ের আকর্ষণ আদিম আকর্ষনের মতোই দূর্বার । বই জ্ঞানের আঁধার কেটে আলোয় নিয়ে আসে । জীবন আলোয় ভরিয়ে তোলে। প্রশান্ত করে তোলে আমাদের মনকে । ভাল বই সবসময়ই আত্মাকে শান্তি দেয় । বই এক আলোক বর্তিকা যা ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসকে দূর করে নিমিষে । কথায় আছে পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই ।

বাংলা সাংস্কৃতির প্রসারে একুশে বইমেলার অবদান অনস্বীকার্য । একুশে বইমেলায় সব শ্রেণীর পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের ঘটে এক অভূতপূর্ব মিলন মেলা । নতুন বই দেখে পুলকিত হয় বই প্রেমিক পাঠক। মনের খোড়াক মেটাতে তারা কিনে নেন পছন্দমতো প্রয়োজনীয় বই । নিজের পছন্দের বইটি কেনার জন্য এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ঘুরে বেড়ান তারা । বিষয়-বৈচিত্রের ভিন্নতা খুঁজেন অনেক পাঠকই । আবার পাঠকের পছন্দের উপর জোড় দিয়ে অনেক প্রকাশক ও লেখক নিয়ে আসেন বৈচিত্রময় ও ভিন্ন রকমের বই । মেলার শেষ সময় পর্যন্ত প্রিয় লেখকের প্রিয় বইয়ের সন্ধানে থাকে পাঠককূল । প্রকাশকরা এই মেলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ । মাসব্যাপী অগণিত পাঠক ও দর্শনার্থীদের পদচাড়নায় মুখরীত থাকে টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ আশে পাশের এলাকা । শেষ দিন পর্যন্ত দুপুর-বিকাল-সন্ধ্যা অব্দি অগণিত লোকে লোকারন্য থাকে মেলা প্রাঙ্গন। ব্যস্ত থাকে এর সড়ক দ্বীপগুলো । দিন যতই যায় ততই প্রান-প্রাচুর্যে ভরে উঠে বইমেলা । যে ভাষার জন্য বাঙালি জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে সেই ভাষার টানে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে সবাই ছুটে আসে এ মেলায় । ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের ভীড়ে যেন এ মেলা ফিরে পায় প্রানের স্পন্দন ।

ইংরেজী নতুন বছর শুরু হতে না হতেই শুরু হয় বইমেলার আগমনী বার্তা। মেলা উপলক্ষে বাংলা একডেমীর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় সেপ্টেম্বর –অক্টোবর থেকেই । স্টল বিন্যাসের আনুষ্ঠানিকতা ও লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দ, স্থান নির্ধারণী ও মেলার সাজ-সজ্জ্বাসহ অন্যান্য আনুসঙ্গিক অন্যান্য কার্যক্রম শেষ করতে হয় জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই । ক্রেতা-দর্শণার্থীদের আকর্ষণ বাড়াতে ও কাছে টানতে স্টলগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন রঙে সাজিয়ে রাখে । ফ্রেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে সকলের কন্ঠে শুরু হয় এ মেলার বিদায়ের সুর।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাঙালির প্রানের উৎসব বইমেলার সৃষ্টির ইতিহাস। এই দিন চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজের সামনে বটতলায় টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলা শুরু করেন । বইগুলো ছিল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী শরণার্থী লেখকদের লেখা বই । তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এককভাবে বইমেলা চালিয়ে নেন । ধীরে ধীরে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হোন । ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমী সরাসরি এই বইমেলায় সম্পৃক্ত হয় । ১৯৭৯ সালে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি যা’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা । ’অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এই বইমেলার আয়োজন সম্পন্ন হয় ১৯৮৩ সালে । কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এ বছর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি । কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে অমর একুশে গ্রন্থমেলার যাত্রা শুরু হয় । ধীরে ধীরে এ মেলা প্রায় সকল বাঙালির হৃদয় ছুঁয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে দর্শনার্থী, লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের উপস্থিতি । যে কারণে মেলাকে ২০১৪ সালে সোহয়ার্দি উদ্যানে সম্প্রসারিত করতে হয়েছে । স্টলগুলো প্রকাশক এলাকা, প্রকাশক-বিক্রেতা এলাকা, শিশু কর্ণার, সরকারি –বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং লিটল ম্যাগাজিন ইত্যাদি এলাকায় ভাগ করে স্থান নির্ধারণ করে দেয়া হয় । এ মেলা চত্বরকে ভাষা শহীদ সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নামে ভাগ করা হয় । দেশের বাইরে থেকেও নানা প্রকাশনা সংস্থা তাদের বই ও প্রকাশনা নিয়ে এ মেলায় অংশগ্রহণ করে । মেলা চলাকালীন প্রতিদিনই মেলাতে থাকে বিভিন্ন আলোচনা সভা, কবিতা পাঠের আসর, গান বাজনা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । যা শুধুমাত্র মেলার ভিতরেই সীমাবদ্ধ নয় । শাহাবাগ, চারুকলা ইনিস্টিটউট, টিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের গ্রন্থাগার সংলগ্ন হাকিম চত্বর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও শিশু একাডেমী সংলগ্ন দোয়েল চত্বর সমস্ত এলাকা জুড়েই পরিনত হয় এক সাংস্কৃতিক উৎসবে । সড়কের দু’পাশে থাকে বিভিন্ন খাবার, বাচ্চাদের খেলনা, ঘর সাজানো মাটির তৈরী মৃৎশিল্প (শোপিস), চটপটি, ফুসকার সাজানো পসরা ।

শাহাবাগের চেতনা স্কয়ার থেকে টিএসসি হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কদ্বীপের দু’পাশে তরুণ তরুণীদের আড্ডা, বাহুল্য কথা, অট্টহাসিতে ফেটে পড়া, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাদামের খোসা, ঝাল মুড়ির ঠোঙ্গা – এ দৃশ্যগুলো আমাদের খুবই চিরচেনা । যা প্রতিবছরই দেখা যায় । এ দৃশ্যগুলো মনের গহীনে সৃষ্টি করে এক ধরনের ভালো লাগা। বারবার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় এইতো বাঙালির মিলন মেলা, মাতৃভাষার মেলা, এক তারুণ্যের মেলা ও পুরানো বন্ধুকে ফিরে পাবার মেলা । মুক্তিযু্দ্ধের চেতনার মেলা, গণতন্ত্রের মেলা ও সৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার মেলা। অন্যায় ও অসত্য ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মেলা। একুশে বইমেলা কবিতা, সাহিত্য-সাংস্কৃতির ও আমাদের কৃষ্টির মেলা এবং ধর্মীয় গোড়ামী, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে দৃঢ় শপথ নেবার মেলা ।

  • লেখক – মো. অহিদুজ্জামান লিটন: কলাম লেখক ও যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি (ল্যাব) ।
পছন্দের আরো পোস্ট