গ্রন্থাগার ও আলোকিত মানুষ

তারুণ্য একটি প্রবল প্রাণশক্তি । বর্ণিল স্বপ্ন তাকে সবসময় আচ্ছন্ন করে । স্বপ্ন ভেতরের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে । তরুণরা স্বপ্ন দেখে ও স্বপ্ন দেখায় ।  তারা সমাজপরিবর্তন ও সংস্কারে বিশ্বাসী ।

আবার অন্ধ বিশ্বাস ও ভ্রান্ত ধারণা মানুষের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে সবসময় শৃঙ্খলিত, রুদ্ধ ও দূর্বল করে । অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে প্রতিটি শিশু । বেড়ে উঠতেই পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে প্রচলিত ধারণার শৃঙ্খলে ধীরে ধীরে বন্দী হয়ে পড়ে সে । ধর্মান্ধতা, গোড়ামী, অজ্ঞতায় আচ্ছন্ন, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অবিদ্যা তার অমিত সম্ভাবনা ও স্বপ্নকে শৃঙ্খলিত করে ফেলে । এমনকি পাপাচারেও তাকে আবিষ্ট করে কখনও কখনও।

বই হচ্ছে পবিত্র এক আলোক দীপ্তি । যার আলোয় আমাদের চারপাশ আলোকিত হয়। পবিত্র হয় মন। দূর করে অন্ধকার । আত্মাকে করে শুদ্ধ, শুভ্র ও পরিতৃপ্ত । বইয়ের আকর্ষণ আদিম আকর্ষনের মতোই দূর্বার । বই জ্ঞানের আঁধার কেটে আলোয় নিয়ে আসে । জীবন আলোয় ভরিয়ে তোলে, প্রশান্ত করে তোলে মানুষের মনকে । ভাল বই সবসময়ই আত্মাকে শান্তি দেয় । বই এক আলোক বর্তিকা যা ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাসকে দূর করে নিমিষে । কথায় আছে পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই ।

মানুষ আলোক পথচারী । আলোর পথে এগিয়েই তিনি হয়ে উঠেন সাদা মনের আলোকিত মানুষ। সে এক সুন্দরের তৃষ্ণার্ত মানব । জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অহিংসা, স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসার মন্ত্রে নবযুগের যাযাবর। জ্ঞানে ‍যিনি নিজেকে করে তোলে সম্পদশালী। তিনি জ্ঞানের প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা, অন্ধজনের চোখের আলো। পান্ডিত্যে ভরা মানবতাবাদি সমাজ সংস্কারক ও সমালোচনার উর্ধ্বে এক মানব সন্তান ।  যাঁর আদর্শ  আমৃত্যু বেঁচে থাকে সকলের হৃদয়ে ।

সুন্দর সমাজ গঠন ও ইতিবাচক সংস্কারে চাই ভালো মনের মানুষ । পরিস্কার মনের বিকাশিত মানুষ আমাদের স্বপ্ন দেখায় । তাঁরা আলোকিত করে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে । সমাজ, রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতায় চেতনায় সমৃদ্ধ নির্মল আত্মার শাশ্বত আলোর পথযাত্রী ও দিক নির্দেশক আলোকিত মানুষ গড়তে পাঠাগার/গ্রন্থাগারের বিকল্প নাই। গ্রন্থাগার আলোকিত করে মানুষকে। মানুষের জ্ঞানের সব দুয়ার খুলে মানবাত্মাকে করে শাণিত, প্রজ্জ্বলিত ও ঝলমলে ।

জ্ঞান অন্বেষনে চাই গ্রন্থ, পত্রিকা, সাময়িকী ইত্যাদি । যার সংরক্ষণ ও ব্যবহারের কেন্দ্র হচ্ছে গ্রন্থাগার । এটি শক্তি, সৌষ্ঠব, বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের ভান্ডার যা মানসিক শক্তির বিশাল সরোবর । গ্রন্থাগারই হচ্ছে আমাদের জ্ঞানের মন্দির যেখান থেকে নিত্য নতুন পরিকল্পনা জন্ম নেয় এবং   ইতিহাসকে জানতে ও শিখতে সাহায্য করে ।

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও মানসিক বিকাশে প্রয়োজন হাতের নাগালে গ্রন্থ । সৃজনশীল ও চেতনার উম্মেষ ঘটাতে সকলের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি করে গ্রন্থাগার । ফলে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে, জ্ঞান অর্জনের পথ আরও সুগম হয়, ধর্মীয় গোড়ামী, কুসংস্কার ও ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে বেড়িয়ে আসার পথ সুগম হয়। দূরদর্শিতা বৃদ্ধি পায়, সঠিক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে এবং সিদ্ধান্তে অবিচল থাকার কৌশল রপ্ত হয় । খারাপ সঙ্গ, আড্ডা, নেশা, সন্ত্রাস ইত্যাদি ত্যাগ করতে সাহায্য করে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার ।

Post MIddle

স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে । স্বপ্ন দেখতে হয় এবং দেখাতে হয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এধরনের একটি প্রতিষ্ঠান যারা অবিরত স্বপ্ন দেখাচ্ছে । আলোকিত মানুষ চাই – এই শ্লোগানে এগিয়ে যাচ্ছে । শিশু-কিশোর, ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীসহ সকল বয়সিদের হৃদয়কে স্নিগ্ধ, সজীব, নির্মল, প্রানবন্ত ও উৎকর্ষময় গড়ে তুলে উন্নতজ্ঞান ও মূল্যবোধ সমৃদ্ধ আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয়ে হাতের নাগালে বাসের মধ্যে ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করেছে । বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন প্রথিতযশা, শিক্ষাবিদ, জ্ঞানী ও আলোকিত মানুষ । তাঁর এই প্রশংসনীয় উদ্যোগ পাঠাভ্যাস ও গ্রন্থাগারের উপযোগীতা সৃষ্টিতে সকলের কাছে অনুকরণীয় ।

রাজশাহীর বাঘা থানার বাউসা গ্রামের ৪র্থ শ্রেণী পাশ পলান সরকার একজন আলোকিত সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা । যিনি বই কিনে নিজের পড়া শেষ করে ব্যাগ ভর্তি করে সাইকেলে চেপে গ্রাম থেকে গ্রামে পৌঁছে দিয়েছেন বাড়ি বাড়ি। এ এক জীবন্ত ও চলন্ত পাঠাগারের উদাহরণ । যিনি মনে করেন মানুষকে আলোকিত করতে কিংবা আলোকিত সমাজ গড়তে গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে ।

বরিশালের লামছড়ি গ্রামের আরজ আলী মাতুব্বর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না । গ্রন্থাগারের অবদানেই একজন দার্শনিক, মানবতাবাদী, চিন্তাবিদ ও লেখক হয়েছেন। সমাজে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন। যিনি তার ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই কাটিয়েছেন পড়াশোনা করে । জ্ঞান বিতরণের জন্য তাঁর অর্জিত সম্পদ দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি।

পবিত্র মনের বিকাশিত মানুষ হতে ও জ্ঞান আলোময় পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিখ্যাত মানুষের বই পড়তে হবে । যাঁদের লেখায় স্বপ্ন থাকে, অধ্যাবসায় হওয়ার দীক্ষা দেয়, সমাজকে আলোকিত করার মন্ত্র শিখায় মনকে আন্দোলিত করে ও সমাজ পরিবর্তনের সুন্দর সুন্দর স্বপ্নের জন্ম দেয়, দেশপ্রেম তৈরী করে, মানবতাবাদী হতে সাহায্য করে সেই ধরনের লেখকের বই গ্রন্থাগারে রাখা প্রয়োজন ।

আলোকিত সমাজ গড়তে নতুন প্রজন্মকে সু শিক্ষায় মানুষ হতে হবে । হৃদয়কোণে সৃষ্টি করতে হবে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ও গ্রন্থাগারের প্রতি দূর্বলতা । তাহলেই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আরজ আলী মাতুব্বর ও পলান সরকারের মতো অসংখ্য সাদা মনের আলোকিত মানুষের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে ।

নতুন প্রজন্মই আমাদের আশা ভরসা, জাতির প্রাণশক্তি, সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার । তাদের উপর নির্ভর করে আমাদের ও দেশের ভবিষ্যত । উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তাদের এগিয়ে যেতে হবে । দিতে হবে  আলোর সন্ধান,  গড়তে হবে আলোকিত সমাজ । স্বপ্ন পূরণে চাই গ্রামে গ্রামে গ্রন্থাগার ।

লেখকঃ মোঃ অহিদুজ্জামান লিটন,কলাম লেখক ও যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি (ল্যাব)

 

পছন্দের আরো পোস্ট