অকৃতজ্ঞ

চরম অপমানিত হয়ে এই মাত্র শামীমের বাসা থেকে বের হয়ে এলেন আনিস। এক বিন্দু অশ্রুর ভিতর দিয়ে বৃদ্ধ ছানি পড়া চোখে তিনি একটি কঁচি মুখ দেখতে পেলেন।একটি কঁচি মুখ চোখে পানি। কাঠের দোকানটির সামনে ফুটপাথে বসে কাঁদছে। দোকানের  মলিক রফিক আচ্ছাছে ধমকাচ্ছে ‘ ন্যাকামী পাইছস। হাতে একটু আঁচ লাগছে তাতেই এক্কেরে কাইত। খাওনের সময় ঐ হাত দিয়াই তো খাস। তহন দেহি নাকি কান্না বাইর অয় না। কাজের সময় যত বাহানা। নে নে হাত লাগা। কালকে যেমনে হওক চালান দিতেই হইব। কত দিন আর ঘুরামু। হেরপর কি আর অরডার পামু? আমার হইছে যত জ্বালা। কোথথেইক্কা যে এইসব আইস্সা আমার কপালে জোটে? “খাওয়ার সময় মহাশয়। কাজের সময় কি আসয় বিষয়”। তার রাগের অবশ্য কিছু কারনও  আছে। চার পাঁচ বৎসর খেটে পিটে ইয়াছির নামের একটি ছেলেকে গড়েপিটে নিয়েছিল। কাঠের কাজে খুব এক্সপার্ট হয়ে উঠেছিল সে। কোন দিক দেখতে হত না তাকে। সামান্য ঘটনায় রাগ করে কিছু দিন হয় সাব্বিরের দোকানে কাজ নিয়েছে। রাগে অভিমানে তাকে সাধতেও যেতে ইচ্ছা করছে না রফিকের। সাধলেও আসত কিনা সন্দেহ। অনেক টাকা টোপ দিয়ে সাব্বির নাকি ওকে ভাগিয়ে নিয়েছে। লোকে তো তাই বলে। বেঈমান সব বেঈমান। দেশটাই বেঈমানে ভরে গেছে। সাব্বিরকে সে ই গ্রাম থেকে এনে ফার্নিচারের ব্যবসায় লাগিয়েছিল। রফিকদের যখন চাল আন্তে পান্তা ফুরায় অবস্থা সাব্বিরের বাবা লাল মিয়া তাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করতো সেই কৃতজ্ঞতায় এম এ পাশ করে সাব্বির যখন বেকার বসে আছে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে বখে যাচ্ছে তার বাবার অনুরোধে রফিকই তো তাকে ঢাকায় এনে ফার্নিচারের ব্যবসায় বসিয়ে দেয়। ঢাকার মানুষের হাতে সবে পয়সা আসতে শুরু করেছে।  দলে দলে বিদেশ যাচ্ছে। গার্মেন্টসের ব্যবসা,জমি কেনাবেচার ব্যবসা,চামড়ার ব্যবসা, অন্যান্য অনেক রকমের ব্যবসার তখন শুভ সূচনা হচ্ছে। অফিস আদালতেও দুই নম্বরী বেড়ে গেছে। মানুষ ফ্যাসনেবল হতে শুরু করেছে। রফিক বুঝেছিল ফার্নিচার ব্যবসার ভাগ্য খুলল বলে। সাব্বিরকে যেদিন ব্যবসায় এনে লাগায় এই কথাই বলেছিল রফিক। ‘ সাব্বিররে  দেহিস ব্যবসা কারে কয়। সাঁই সাঁই কইরা উইটঠ্ঠা যাবি’। কথাটা মিথ্যা হয়নি।  শিক্ষিত ছেলে সাব্বির খুব তাড়াতাড়ি ব্যবসাটা ধরে ফেলে। রফিকের চোখের সামনেই সাঁই সাঁই করে ওঠে গেল ছেলেটা। এই ব্যবসায় রুচি একটা বিশাল ব্যাপার। সাব্বির শিক্ষিত ছেলে রুচিটা তার ছিল। এখনতো সে নাকি বিদেশেও ফার্নিচার রপ্তানি করে। রফিক সাব্বিরের এই রমরমার কথা যতই চিন্তা করে তার বেঈমানির কথা ততই মনে পড়ে আর ততই সে রাগে জ্বলে ওঠে।

কয়েকদিন হয় হাতের পাঁচ এই ছেলেটাকে পেয়েছে। তবে ছেলেটা কাজের হবে বলে মনে হয় না। নিজ থেকে কোন কাজ ধরতেই চায় না। এই সব নানা কারনে বেশ কদিন থেকেই রফিকের মেজাজ বিগড়ে আছে।  আর এই নিরীহ ছেলেটার উপর সেই ঝাল ঝাড়ছে। তবু তার গায়ের জ্বালা কমছে না।

ঠিক এই সময় আনিস অফিস থেকে ফিরছিলেন। ছেলেটার মায়া কারা চেহারায় তাঁর চোখ আটকে গেল। কত আর বয়স হবে ছেলেটার? রাকিনের সমানই হবে হয় তো। গরীবের ছেলে। এই বয়সেই কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। আহারে! এখন তো মায়ের কোলে থাকার কথা। রাকিনের চেহারটা মনে পরতেই পিতৃস্নেহে ওর হৃদয়টা নরম হয়ে উঠল। আনিস একটু এগিয়ে গেলেন।  দেখলেন ছেলেটার হাতে অনেকখানি পোড়া। চামড়া ছিলে গেছে। স্পিরিটের কাজ। জ্বলে হয়তো তাই সে কাজ করতে চায় না। আনিসের চোখে পানি এসে গেল।

‘কেমন করে এমন হল’।

রফিকই উত্তর দিল। উষ্মাটা কারো কাছে উগড়ে দেয়া প্রয়োজন ছিল তার ‘ আর কইয়েন না স্যার।  কত কইরা কই সাবধানে কাজ কর।  না। কাজের সময় মন পইরা থাকে বাড়ীতে’। একটু থেমে আবার বলে ‘স্পিরিট লাইটের আগুনে হাত পুড়ছে। তেমন কিচ্ছু না। হেই বাহানাতে আছে। কাজে হাত দিব না কিছুতেই’।

আনিস একটু কৌতুহলি হলেন ‘কোথায় পেলেন ওকে?’

‘ রাস্তায় ঘুরতাছিল। কইলাম কাজ করবি। রাজি হইল। অহন তো দেখছেন এই অবস্থা। শুধু অন্ন ধ্বংস। ফেলাইতেও পারতাছিনা রাখতেও পারতাছিনা। গলার কাঁটা হইছে স্যার’।

আনিস সাহস করে বললেন ‘ বাচ্চাটাকে আমি নিয়ে যাই। আমাকে দিয়ে দেন’। আনিস তখন ভাবছিলেন রকিনের সমানই যখন ওর সাথে খেলতেও পারবে আবার অনিতার হাতের পাঁচ টুকটাক কাজও করতে পারবে। আনিসকে অবাক করে দিয়ে রফিক রাজি হয়ে গেল। রফিক লোক চড়িয়ে খায় সে বুঝেছিল ছেলেটি কাজের হবে না। শেষমেশ বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

                                (২)

ডাইনিং টেবিলে বসে নিতা রাকিনকে পড়াচ্ছিল। এবার কেজি টুতে উঠেছে রাকিন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এত পড়া কুলান যায় না। এতটুকু বাচ্চা হাফিয়ে উঠে। শুধু পড়া আর পড়া। খেলা নাই ধূলা নাই। চব্বিশ ঘন্টা পড়া। একেকটা রোবটের মত ছেলে মেয়ে। নিতা মনে মনে ভাবল কি আর করা যাবে। সেতো আর সব কিছু চেঞ্জ করতে পারবে না। ‘হয়েন ইউ আর ইন রোম এক্ট লাইক রোমানস’। টেবিলে বসেই এরকম নানা কথা ভাবছিল নিতা। ভাবানা গুলো কোথাও দাঁড়াচ্ছিল না। একটা থেকে গড়িয়ে যাচ্ছিল আরেকটাতে।  হঠাৎ ও খেয়াল করল নুতন ছেলেটা ডাইনিং টেবিলে থুতনী রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে রাকিনের পড়া দেখছে। অন্য সময় হলে হয়তো খেয়ালই করত না কিন্তু নতুন কেউ এলে এমনিতেই একটু কৌতুহল হয়। মানুষ নবাগতের আচার আচরন অবলোকন করতে ভালবাসে।  অবচেতন মনেই করে এই কাজটি।

নিতা জিজ্ঞেস করল ‘ লেখা পড়া করবি?’

ছেলেটা মাথা হেলিয়ে দিল।

সারা দিন একটা অস্থিরতার মধ্যে কাঁটল নিতার। উৎসাহ তাকে পেয়ে বসেছে।

আনিস বাসয় ফিরতেই বলল’ কালকে অফিস থেকে আসার সময় একটা আদর্শলিপি নিয়ে এস তো’। এসব ক্ষেত্রে অনেকেই ধৈর্য্য ধরতে পারে না। বিশেষ করে মেয়েরা। মধ্যবিত্ত গৃহিনীদের জীবনে সাধারনতঃ নুতনত্ব বা উত্তেজিত হবার মত ঘটনা কমই ঘটে। তাছাড়াও অবচেতন মনে কোন একটা ভাল কাজ করার বাসনা মানুষের থাকেই কিন্তু সব সময় সেই সুযোগ আসে না। কচ্চিৎ যদি আসে আবেগ ধরে রাখা কঠিন হয়। যদিও সেই আবেগ দীর্ঘদিন ধরে রাখা তার চেয়েও কঠিন। কেননা সেই সদউদ্দেশ্যের উপযাজক হয়ে যে সমস্ত যন্ত্রনা আসে অনেকের পক্ষেই তা সহ্য করা সম্ভব হয় না। ফলে এই রকম উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত টিকেনা বা আধা খেচড়া হয়ে পড়ে থাকে।

আনিস বললেন ‘কেন? কি করবে আদর্শলিপি দিয়ে?’

‘নুতন ছেলেটাকে পড়াব। ও মনে হয় পড়তে চায়। দেখিনা একটু চেষ্টা করে’।

এসব ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ কয়েক দিন পর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।  বই দেখলে উভয়েই বিরক্ত হয়। বেগতিক দেখে বই কোথায় প্রস্থান করে তার হদিস কেউ রাখে না। এ ক্ষেত্রে কিন্তু তা হলো না। ছেলেটার পড়ালেখায় বেশ আগ্রহ। আগ্রহটা যেন একটু বেশী। কাজে একদম মন নেই। কোন কাজে ডাকলে সেটা করে গিয়ে আবার পড়তে বসে। নিজ থেকে কোন কাজ ধরেই না। কিছু দিন পর এটাই নিতার বিরক্ত লাগতে লাগল। কিছু বলতেও পারে না। নিজেই তো তাকে পড়ালেখায় ঢুকিয়েছে। তবে অসহযোগীতার ত্রুটি করে না। পড়তে বসলেই ডাকে। ছেলেটাও যেন কেমন ঘাড় গোজ করে এসে কাজ করে। মুখে কোন কথা নেই। হাসিতো একেবারেই নেই। তার একটুও মায়া লাগে না। কিন্তু সহ্য করতে হয়। আনিস কেন জানি খুব ভালবাসে ছেলেটাকে। টাকা পয়সার অভাবে আনিস বেশী দূর লেখাপড়া করতে পারেনি। বাবা ছোট বেলায় মারা যায় তাই ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। এই কারনে সে বিয়েও করেছে দেরীতে। তাই সে যতটা না ভাই বা অন্য কিছু তারচেয়ে বেশী পিতা। আপত্ত্য স্নেহে সে সব সময় আপ্লুত হয়ে থাকে। ছেলেটার পড়ালেখায় আগ্রহ দেখে তার খুব ভাল লাগে। দোষগুলো তাঁর চোখেই পরে না। এটাও নিতার গাত্রদাহের আরেকটা কারন। নিতা শামীম সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে আনিস এমন অবিশ্বাসের চোখে তাকায় যে নিজেকেই ছোট মনে হয়। আনিসের সামনে তাই কিছু বলে না নিতা কিন্তু তার অগোচরে একপ্রকার অত্যাচারই করে। শামীমও জিদ করেই যেন টপাটপ ক্লাস গুলো শেষ করতে থাকে। উম্মোক্ত বিশ্ববি্যালয়ের অধীন এসএসসি পাশ করে ফেলে। ক্রমে বিএ এমএও।  আনিস যদিও একটা কর্পোরেশনে মাঝারি সাইজের চাকরী করে। তবে ওর কিছু বড় বড় বন্ধুবান্ধব আছে। তাদেরই একজনকে ধরে শামীমকে জনশক্তি রপ্তানীতে এলডি পোষ্টে ঢুকিয়ে দেয় আনিস।

                                 (৩)

এখন দুই পক্ষেরই প্রয়োজন ফুরিয়েছে। শামীমকে আনা হয়েছিল রাকিনের খেলার সাথি হিসেবে। রাকিন এখন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ে অথর্নীতিতে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পরে। শামীমের চাকরী হয়েছে। নিতা আর শামীমকে রাখতে চায় না। মনে মনে ভাবে ছেলেটা কেমন যেন স্বার্থপর। নিজের জগৎ নিয়ে আছে। রাস্তা থেকে এনে মানুষ করেছি অথচ এই সংসারের কোন কিছুতেই তার যেন কিছু যায় আসে না। নিজের ঘরটার মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। কে এল কে গেল কোন খেয়াল নেই। সেই দিকে আবার টনটনে। পাতে একটু মাছ কম পরলে মুখ কালো। কথা তো বলেই না। দশটা পশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝে এমন ভাব করে যেন বিনা পয়সায় ওকে খাঁটিয়ে নিচ্ছি।  ফুল বাবু। আনিসের উপর তার রাগ উঠে যায়।  বোকার হদ্দ। কোথাকার কোন ছেলে হুট কে ঘরে এনে তুলল। এখন আবার কত ন্যাকামী। পড়ালেখা কর পড়া লেখা কর। সময় পেলেই ডিমটা কলাটা দিয়ে আসা চাই। এদিকে নিজের ছেলের দিকে কোন খেয়াল নেই। বললে বলবে ওর জন্য তুমি তো আছ।

চাকরী পাওয়ার পর শামীম নিতাকে সালাম করতে এল নিতা বলল ‘ শামীম এখন তো তোমার চাকরী হয়েছে। তোমার খালুর অবস্থা তো জান। ছেলেটাকে পড়াতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। তুমি এখন নিজেরটা দেখ’।

শামীম শুধু বলল ‘ আচ্ছা’।

                                 (৪)

আনিস দাঁড়িয়ে আছেন গোলিস্তানের  মোড়ে ফুটপাতের উপর। তিনি রাস্তা পার হয়ে ওপারে যাবেন।  ওপার থেকে বাসে উঠে মিরপুর। সকালে স্টক এক্সচেঞ্জে এসেছিলেন। আরো অনেকের মত শেয়ার মার্কেটে ভীষন ভাবে ধরা খেয়েছেন।  রিটায়ারের পর যেখানে যা কিছু ছিল কুড়িয়ে বাড়িয়ে এনে শেয়া মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন কিন্তু দশ সনের মহাপতনে সব শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি সর্বশান্ত। কিছু উদ্ধারের আশায় রোজ স্টক এক্সচেঞ্জে এসে বসে থাকেন। সকালে আসেন বিকালে যান।  অনেকে কম্পিউটারে দেখে নেয়। ডিজিটাল জিনিসটাকে বড় ভয় পায় আনিস। ছেলে কত করে শেখাতে চেষ্টা করে কিন্তু তিনি কিছুতে শিখে উঠতে পারেন না। সব ভুল ভাল হয়ে যায়। কোথা থেকে কোথায় চলে যান তারপর সাটডাউন করে বসে থাকেন। তাই রোজ রোজ আসতে হয় এখানে। যা কিছু সম্পদ ছিল সব এনে এখানে বিনিয়োগ করেছিলেন। ভেবেছিলেন ছেলেটা ইউনিভার্সিটিতে ভাল রেজাল্ট করেছে। এম এস করার জন্য এমেরিকায় একটা স্কলারসিপও পেয়েছে। ওরা ফিফটি পার্সেন্ট দিবে। ভেবেছিলেন বাকি ফিফটি পারসেন্ট দিলেই ছেলেটা এম এসটা করে আসতে পারবে। কিন্তু এর মধ্যেই সর্বনাশ হয়ে গেল।

এত ব্যস্ত রাস্তা। তিনি কোনভাবেই পার হতে পারছেন না। ফুট ওভার ব্রীজটা অনেক দূরে। বেশ অনেকটা হাঁটতে হবে। তিনি বিষন্ন চিন্তিত এবংএতখানি ক্লান্ত যে ঐ পথটা হাঁটতে ইচ্ছা করছে না।

এমন সময় ঠিক সামনে এসে একটা সাদা টয়োটা কার দাঁড়াল। সিগনাল পরেছে। সিগনালে গাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে। শামীম ভিতরে বসা। গাড়ীটা এত কাছে দাঁড়ান যে তিনি পস্ট দেখতে পেলেন শামীম চট করে চোখ সরিয়ে নিল।

                                  (৫)

নিতা ঐ কথাগুলো বলার পর শামীম সোজা ওর ছোট ঘরটাতে গেল। ভাঙ্গাচোড়া চৌকিটার নীচ থেকে ছেড়া ব্যাগটা টেনে বের করল। রাকিনের দাদী যখন খুব অসুস্থ্য বুঝতে পারছিলেন মারা যাবেন নিজের জিনিসপত্র সব ভাগ করে দিচ্ছিলেন তখন এই ব্যাগটা শামীমকে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন’ শামীমরে এই পরিবারের অবদান ভুলিস না। কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলে বেশী বড় হওয়া যায় নারে ভাই’। ঐ বৃদ্ধ মহিলার সাথে কেমন করে যেন শামীমের একটা আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দুইজন আশ্রিত অবহেলিত মানুষের সহমর্মী হয়ে উঠা খুব স্বাভাবিক। হয়তো সেই জন্যই। শামীম কলেজ থেকে এসে নিতার অবস্থান আঁচ করে নিয়ে দাদীর পায়ের কাছে বসত। পা টিপতে টিপতে তার মনের অর্গল খুলে দিত। পুর্ব জীবনের যতটুকু মনে আছে তার সাথে কিছু রং মিশিয়ে বলে যেত। মা বাবার কথা। ছোট ভাইটার কথা। একটা ঘটনাই তার খুব মনে আছে। ছোট ভাইটাকে নিয়ে পুকুরে নেমেছিল। এক সময় হাত ফঁসকে কোথায় যে চলে গেল। আর খোজে পেল না। সেই ভয়ে সেই যে দৌঁড় লাগাল তারপর কোন দিক দিয়ে কি হলো সে আর কিছুই মনে করতে পারে না। আজকে চামড়ার ব্যাগটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ দাদির কথা মনে পরায় শামীমের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পরলো। যে কয়টা কাপড় চোপড় ছিল ব্যাগটাতে ভরে নিয়ে সোজা বের হয়ে গেল। ওর মুখটা আষাঢ়ের মেঘের মত থমথমে। নিতা দেখল তার সমনে দিয়ে শামীম বেরিয়ে গেল কিন্তু কোন কথা বলল না।

                                (৬)

Post MIddle

‘কয়েকটা দিন তোর এখান থাকতে হবে রে দোস্ত’……সেলিমের এক কামরার ঘরটার দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শামীম বলল। সেলিম তখন ইলেক্ট্রিক হিটারে ভাত চড়াচ্ছিল। এতটকু ঘরের মধ্যেই তার সংসার। একটা ছোট চৌকির পাশে একটা নড়বড়ে টেবিলে রান্নার সরঞ্জাম। ইলেক্ট্রিক হিটার হলুদ মরিচের কৌটা। টুকর্রীতে আনজ পাতি পেয়াজ। পরিপাটি করে গোছান। একজন থাকার মত নীচু চৌকিটাতে সস্তা একটা চাদর টানটান করে পাতা। পেরেকটানা দঁড়িতে ইস্তিরি করা কাপড় চোপড় পরিপাটি করে সাজনো। সেলিম চাকরীটা ছোট করলেও রুচিটা বেশ উন্নত। সে বারোয়ারী মেছে থাকতে পছন্দ করে না তাই ভাড়া একটু বেশী হলেও অনেক কষ্টে এক তলার এই ছোট ঘরটা খোঁজে বের করেছে। সামনের ছোট উঠোনটা এই ঘরটার একটু বিলাসিতা। সেখানে সে দুটো নয়ন তারার গাছ লাগিয়েছে। রেগুলার জল দেয়ায় বেগুনী আর সাদা নয়ন তারারা সারা বৎসর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। নিয়মিত ঝাট দেয়া উঠোনটা তাই দেখতে ভারী ভাল লাগে। ঘরের জানালা দিয়ে এক চিলতে আকাশও দেখা যায়। সেলিম বেসরকারী অফসের পিয়নই তবে বেসরকারী বলে তার বেতনটা  একটু বেশী এবং সে বেশ ধোব দূরস্থও।

সেলিম মুখ ঘুরিয়ে আশ্চর্য হয়ে তাকাল। আন্দাজ করে বলল’ একেবারে পপাত ধরনীতল?’। ঠাট্টাচ্ছলে আরেকটু বলতে যাচ্ছিল ‘রাজ পুত্রের পুচ্ছ কি খসে গেল?’ কিন্তু শামীমের চেহারার দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। সে জানে শামীমের আত্মসম্মান জ্ঞান একটু বেশী। তার বঞ্চিত জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা বন্ধুদের কাছে বলতে সে সংকোচ বোধ করে। বন্ধুরা যখন তাকে রাজপুত্র বলে সম্বোধন করে সে তা নিরবে মেনে নেয়।  কোনরূপ প্রতিবাদ করে না। মাঝে মাঝে ঐ ঠাট্টা তামাশায় সে নিজেও যোগ দেয়।

‘ কি হয়েছে রে দোস্ত এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?’

‘আজ আর কিচ্ছু বলতে ভাল লাগছে না পরে বলব। এখন আমাকে একটু ঘোমাতে দে। ব্যাগটা চৌকির একপাশে রেখে একটা পাজামা পরে সটান শুয়ে পরে। তারপর আর নড়াচড়ার কোন লক্ষন দেখা যায় না। মাঝে মাঝে শুধু আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোনগুলো মুছতে দেখা যায়। সেলিম কিছু না বলে যত দূর সম্ভব নিঃশব্দে কাজ করতে থাকে।

                             (৭)

সারা রাত পড়েছে শামীম। কালকে পরীক্ষা। ভোরের দিকে শধু একটু চোখ লেগেছে। হঠাৎ ক্ষুধায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাতে খালাম্মাদের দাওয়াত ছিল। সম্ভবতঃ কোন কিছুই রান্না হয়নি। কয়েক দিন থেকে ছুটা বুয়া আসছে না। রাতে খাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল কিনা তাও বুঝতে পারছে না। আস্তে আস্তে রান্না ঘরে গিয়ে দেখে একদম ফাঁকা। ফ্রিজ খুলে দেখে একটা বক্সে অল্প কয়টা ভাত রাখা আছে। নীচের ক্যাবিনেটে কয়েকটা ডিম। আর কিছু নেই। ডিম ধরবে কি ধরবে না চিন্তা করেও একটা ডিম ভেজে ভাত কয়টা দিয়ে খেল। সকালে ভীষন ক্ষুধা লেগে গেল। নয়টায় ওর পরীক্ষা। নাস্তার কোন খবর নেই। সবার খাওয়া হলে পর ওর খাওয়া। তা হতে হতে নয়টা পার হয়ে যাবে। ততক্ষন অপেক্ষা করা যাবেনা।  সেই সাত সকালেই সে দেখেছে বুয়া ট্রেতে করে রাকিনের  জন্য নাস্তা নিয়ে গেছে। শামীম আর দেরী করল না। বের হয়ে গেল। ওর কাছে নাস্তা করার পয়সাও নেই।  জগতে তার এমন কেউ নাই যে এটা খেয়াল করবে। খালাম্মার কাছে আজকাল টাকা চাইতে ভাল লাগে না। কেমন যেন মুখ কালো করে। এই সব ভাবতে গিয়ে ওর ভিতরে কেমন একটা ক্ষোভের জন্ম হয়।

যতদিন পর্যন্ত রাকিন ভাইয়া স্কুলে যেত ততদিন ওর মুল্য ছিল। রাকিনকে সেই স্কুলে নিয়ে যেত নিয়ে আসত। এখনও ওর মাথায় ঢুকে না খালাম্মা রাকিনকে একলা ছাড়ত না অথচ সমবয়সী একটা বাচ্চা ছেলের হাতে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিত। রাকিন বড় হয়ে যাওয়ার পর ওর মূল্য কমে গেছে। পুরানো একটা আসবাবের মত এখন সে পরিত্যাক্ত।  নিজেকে অবাঞ্চিত উৎকট ঝামেলা মনে হয় এবং রাকিনের তুলনায় অন্যদের  ব্যবহারের বৈশাদৃশ্যে ভিতরে ভিতরে জ্বলতে থাকে। হিংসা নয় একধরনের ক্ষোভ বিতৃষ্ণা। সে নিজেকে ক্রমেই আরো গুটিয়ে নেয়। নিঃশব্দে এক কোনে পরে থেকে নিজের পথ করে নিতে চেষ্টা করে। লেখা পড়ার উপর আরো বেশী করে ঝাপিয়ে পরে। মনে মনে বলে ‘আর কয়টা দিন ধৈর্য ধর শামীম। সবুরে মেওয়া ফলে। এই সূতার মত আশ্রয়টুকু অবলম্ব করে মাকড়সার মত উপরে উঠে যেতে হবে।’ স্বার্থপর এই ছেলেটাকে আনিস ছাড়া এই বাড়ির আর কেউ সহ্য করতে পারছে না। অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু কেইবা পছন্দ করে?

                               (৮)

নিতা প্রকারান্তরে শুনতে পায় শামীমের এখন অনেক টাকা। ম্যান পাওয়ারের চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে। এখন নাকি ম্যান পাওয়ারের ব্যাবসা করছে। প্রচুর পয়সার মালিক হয়েছে। গুলশানে ফ্লাট নিয়ে থাকে। শামীমের বৌকে একদিন নিউমার্কেটে বাজার করতে দেখেছে। চেনা যায় না। পালিশ করা চামারার মত চকচক করছিল। নিতা ওকে চিনতে পেরেছিল কিন্তু শামীমের বৌ চেনেনি। চিনবেই বা কিভাবে। একবার মাত্র দেখা হয়ে ছিল একটা বিয়েতে। নিতা  নিজেকে একটু আড়াল করেই রেখেছিল। কেমন একটা হীনমন্যতা কাজ করছিল।  শেয়ার মর্কেট ধ্বসের পর খুব কষ্ট যাচ্ছে সংসারে। আনিস কোন কূল কিনারা করতে পারছে না। অনিতা মনে মনে বলছিল মানুষ এত বেঈমান হয়। সেই যে শামীম বেড়িয়ে গেল আর কোনদিন উকিও দিল না। কম করেছে ওর জন্য? সেই কথাটাই মনে পরল অনিতার ‘এক গাছের ছাল কখনও অন্য গাছে লাগেনা’।

                            (৯)

সারা দিন  জ্বর জ্বর থাকে ছেলেটার।  ভাল ডাক্তার দেখানোর মতো অবস্থাও নেই এখন। ধারদেনা হয়ে গেছে প্রচুর। দেনা করেই তো চলছে সংসার। যেখানে যা ছিল সব নিয়ে কেন যে শেয়ারে লাগাল আনিস। কোন ভিমরত্তি ধরে ছিল কে জানে। কত স্বপ্ন অনেক পয়সা হলে একটা ফ্লাট কিনবে। রাকিনকে বিদেশ পাঠিয়ে এম এস করিয়ে আনবে।  একট গাড়ীও কেনা চাই। ‘ গাড়ী এখন আর বিলাসিতা নয় বুঝলে রাকিনের মা’ এক রাশ স্বপ্ন চোখে নিয়ে কথাগুলো বলে যেত আনিস। একদিন সব শেষ। রাজা থেকে ফকির।

সন্ধ্যা থেকে রাকিনকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছে নিতা। এর মধ্যেই পাঁচ জন ডাক্তার চেঞ্জ করেছে। কেউ ধরতে পারছে না আসলে ছেলেটার কি হয়েছে? ছেলেটা দিনদিন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। প্যারাসিটামল খেতে খেতে এখন আর খেতে চায় না। রাত প্রায় এগারটা। সিরিয়াল আর আসেই না। এই মাত্র ডাক্তারের চ্যাম্বারে ডাক পরল।

‘কত দিন থেকে জ্বর?’ আগের ফাইল গুলো দেখতে দেখতে ডাক্তার জিঙ্গেস করলেন।

‘মাস ছয়। এই আসে এই ছাড়ে। ‘

ডাক্তার কতগুলো টেস্ট লিখে দিলেন। শেষ পর্যন্ত যা ধরা পরল তা ভয়ংকর।

রাকিনের জটিল কিডনী সমস্যা । একটা প্রায় সম্পূর্ন আরেকটা সিকস্টিপার্সেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। কিডনী ট্রেন্সপ্লেন্ট ছাড়া উপায় নেই। অনেক কষ্টে একজন ডোনার জোগার হয়েছে। তবে অনেক টাকার দরকার। আনিসের এখন যা অবস্থা কোন ভাবেই এত টাকা যোগার করা সম্ভব নয়। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বন্ধব সাধ্যমত করছে। কিন্তু তা আর কত? একমাত্র সন্তানের এই অবস্থা নিতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সারাদিন কান্না কাটি করে আর আল্লাকে ডাকে। শুনেছে শামীমের অনেক টাকা। সে নাকি দেশের মানুষের জন্য সাধ্যমত করে।  উপায়ান্ত না দেখে নিতাই একদিন বলল’ আচ্ছা একদিন শামীমের কাছে যাওনা। শুনেছি ওর অনেক টাকা পয়সা। তুমি গিয়ে দাঁড়ালে কি আর না করতে পারবে? ওর জন্য তো তুমি কম করনি’। নিতা অনেক দিন বলেছে এই কথাটা কিন্ত আনিস কোন ভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত শামীমের কাছে হাত পাততে হবে? যত বার মনে করেছে নিজের কাছেই নিজে ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু রাকিনের অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকালে আজকাল তার মনে হয় ওর জন্য সে ভিক্ষাও করতে পারে। একদিন তাই সাহস করে শামীমের কাছে গেলেন।

শামীম বাসায়ই ছিল। বেড রুমে বসে টিভি দেখছিল। ওর বউ মুক্তি এসে খবর দিল ‘একজন বুড়ো মতন লোক এসে বসে আছেন।  মনে হয় তোমার গ্রামের কেউ হবে। একবার দেখবে নাকি?’

অনিচ্ছা সত্বেও সে উঠল। আনিসকে দেখে বেশ খুশী হলো।

‘কখন এসেছেন  খালু? হইচই করে পিছন ফিরে বলল’ আমাকে আগে বলবে না। তুমি খালুকে চিন না? এদিকে আস এদিকে আস। এই আপনাদের বৌমা।’ অস্থির হয়ে ছেলেকে ডাকতে লাগল’ সজল এদিকে আস। দেখ কে এসেছে। উনি তোমার দাদু হয় ‘। সজল ছালাম দিলে বলে ‘শুধু ছালাম দিলে চলে? পায়ে ধরে ছালাম করো।’সজল তাই করল। স্ত্রী দিকে চেয়ে ইঙ্গিত করল ভাল নাস্তা দেয়ার জন্য।

অনেক নাস্তা টাস্তা খাওয়াল। পিড়াপিড়ি করতে লাগল খেয়ে যাওয়ার জন্য।

এত আপ্যায়নের মাঝে নিজের কথাটা বলতেই কেমন বাধ বাধ ঠেকছিল আনিসের। কন্ঠের কাছে এসেও কথাটা আটকে যাচ্ছিল। শামীমই সহজ করে দিল ‘আমার কাছে কেন আসছিলেন খালু?

আনিস আমতা আমতা করে এক নিঃশ্বাসে বলেই ফললেন ‘তুমি তো বোধ হয় জাননা’ বলে একটু থামলেন। সময় নিলেন । সাহস সঞ্চয় করলেন। ছেলের কথা চিন্তা করতে বা তার সম্পর্কে কথা বলতে তাঁর সাহস সঞ্চয় করতে হয়। কারন তিনি অতি কষ্টে ওর পরিনতির চিন্তাটাকে দূরে সরিয়ে রাখেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন’ রাকিনের দুইটা কিডনীই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। ট্রেন্সপ্লেন্ট লাগবে। অনেক টাকার দরকার’। আবার থামলেন। বড় একটা নিঃশ্বাস নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো। দম নিয়ে বললেন’ শুনেছি তুমি অনেকের জন্য কর তাই অনেক আশা নিয়ে এসেছি’।

কথাটায় শামীম যেন একটু গম্ভির হলো।

একটু সময় নিয়ে বলল’ ইদানিং ব্যবসার অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। সরকারের তো কোন মাথা মুন্ডু নেই।  এমন কত গুলো আইন করেছে যে’ বলে  থামে ‘ এই করতে পারবা না সেই করতে পারবা না। এত টাকার বেশী নিতে পারবা না। এখন বাইরে লোক পাঠানো মানে লস।’ তার অবস্থার একগাদা  ফিরিস্তি দিয়ে একটু উঠার ভঙ্গি করে বলল’ আচ্ছা দেখি আপনার জন্য কি করতে পারি’। সে উঠে ভিতরে গেল। ফিরে এসে বিশ হাজার টাকা আনিসের হাতে দিয়ে বলল ‘এখন যা অবস্থা এর চেয়ে বেশী দিতে পারছি না খালু’।

আনিস লজ্জায় মরে গিয়ে বললেন ‘ঠিক আছে ঠিক আছে। ‘ তারপর টাকাটা নিয়ে কতক্ষনে বের হবেন ভাবছেন।

দরজা দিয়ে বের হতে হতে তার মনে হলো কে যেন দড়াম করে তাঁর পিছনে একটা লাথি মারল। তিনি শুনতে পেলেন শামীমের বউ বলছে ‘আরেকটু বেশী দিলেই পারতে’।

একটা পুরুষ কন্ঠ উত্তর দিচ্ছে ‘বেশী পাত্তা দিও না। পরে সামলাতে পারবে না। ‘

 

মাহবুবা হোসেইন । কর কমিশনার 

পছন্দের আরো পোস্ট