৫০ বছরে লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়
অর্জনের ভারে নুয়ে পড়েছে খ্যাতির চূড়া। নানা গল্প, নানা স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে সেই ৫০ বছরের পুরনো দালান। কয়েকজন ছাত্রী এখনো টিকে আছে সেই প্রথম বছরের অনুভুতি নিয়ে। ছোট্ট কুঁড়ি থেকে আজ ডালপালা গজানো এক পূর্ণ বৃক্ষে পরিণত লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা কলেজগুলোর মধ্যে খ্যাতির খাতিরে অন্যতম নাম লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পেরিয়ে এবার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে এই বিদ্যাপীঠ। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর নানা পথ পেরিয়ে এখন ভরা যৌবণা এই বিদ্যাপীঠ। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৫০ বছর। ২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১২ বিঘা জমির উপর একটি মাত্র ভবন দিয়ে যাত্রা শুরু করে লালমাটিয়ার এই বিদ্যাভুবন।
কলেজের এক স্মরণিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লালমাটিয়া কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির উদ্যোগে। সোসাইটির টাকা, উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং বিত্তবান ব্যক্তিদের সহায়তায় কলেজটি দাঁড়িয়ে গেছে। এখন এর শিক্ষার্থী প্রায় সাত হাজার। শিক্ষক ১৩১ জন।
গতকাল সোমবার কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, সুবর্ণজয়ন্তীর মহা ধুমধাম প্রস্তুতি চলছে উৎসাহ ভরে। মিলনায়তনে গিয়ে দেখা মেলে সাংস্কৃতিক মহড়ারত শিক্ষার্থীদের সাথে। তখনই জানা গেল সনামধন্য টিভি তারকা সমী কায়সার এই বিদ্যাপীঠের ফসল। মিলনায়তনে সবাই মহড়া নিয়ে ঘোরতোর ব্যস্ত। বাংলা বিভাগের ছাত্রী রুবাইত তাসমীন বলেন, সুর্বণ জয়ন্তী উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে কলেজ। এই দিনটি আমরা উদযাপন করতে চাই, উপভোগ করতে চাই। বাবা-মা, ভাই-বোনকে নিয়ে গঠিত পরিবারের পর এটাই আামাদের দ্বিতীয় পরিবার।
বর্তমানে কলেজে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থীর জন্য আছে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে। লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয় ১৯৯১ সালে ঢাকা মহানগরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। ২০১৫ সালে সারা দেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত কলেজের মধ্যে হয় দশম। ২০১৬ সালে উচ্চমাধ্যমিকে পাসের হার ছিল ৯১ শতাংশ। আর স্নাতক সম্মানে পাসের হার ৯৭। নিয়মিত পাঠ্যক্রম ছাড়াও শিক্ষার্থীরা খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে কলেজের প্রতিনিধিত্ব করেন।
কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, এখন ১৭টি বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ও ১৫টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পড়াশোনা ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ এখানে রয়েছে। এটি বেসরকারি কলেজ হলেও ফি অনেক কম। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থাও ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়। শিক্ষার্থীদের সব লেনদেন, তাদের প্রোফাইল—সব অনলাইনে হয়। শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মচারীদেরও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কলেজেই ফ্রিল্যান্স প্রশিক্ষণ নিয়ে মাসে ভালো আয় করছে এক শিক্ষার্থী।
বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সায়মা জাহান জানান, ১৯৮৩ সাল থেকে তিনি কলেজে আছেন। বললেন, প্রায় ১০০ প্রজাতির গাছ আছে। কলেজটি ঘুরে দেখালেন। ঘুরতে ঘুরতেই বললেন, ‘কলেজটি আমাদের শ্রমের ওপর নির্ভর করে চলে।’ কলেজ থেকে পাস করা অনেকেই এখন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত। অভিনেত্রী শমী কায়সার এখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন। বদরুন্নেসা আহমেদ ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ। বর্তমানে শিক্ষকদের মধ্যে ২১ জন শিক্ষক এ কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথমবারের মতো তাঁরা শুরু করতে যাচ্ছেন অ্যালামনাই প্রোগ্রাম।
লালমাটিয়া কলেজে এসওএস শিশুপল্লির ১০ জন শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে পড়ছে। এ ছাড়া শাহনাজ আক্তার নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীও পড়ছে এই কলেজে। মাঠে দেখা গেল, শাহনাজকে হাতে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তার সহপাঠী। হালকা-পাতলা গড়নের শাহনাজের মুখে হাসি লেগেই আছে। সে একাদশ শ্রেণিতে মানবিক বিভাগে পড়ছে। এসএসসির ফল জিপিএ-৪। তার ইচ্ছা, আইনজীবী হবে। ওর সহপাঠীরা জানায়, সবাই নিজ থেকেই শাহনাজকে সাহায্য করে। কাউকে ডাকতে হয় না। শুধু শিক্ষাই নয়, কলেজটি এমন মানবিক মূল্যবোধও সৃষ্টি করেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
হাজারো কথামালা আর নতুন পুরোনো প্রাণের এক মহামিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল লালমাটিয়া মহিলা মহ্যাবিদ্যালয়ে। গতকাল (২৬ ডিসেম্বর) সোমবার সুর্বণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে প্রধান অতিথি ছিলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সরকার। উৎসবের এই মহা সন্ধিঃক্ষনে প্রধান অতিথির বক্তব্য যোগ করে নতুন মাত্রা। হাস্য রসাত্মক ও স্মৃতিচারণ মুলক বক্তব্যে অনুষ্ঠানে নতুন মাত্রা এনে দেয়। কলেজ থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রীরা আগামীতে নিজেদের মেধা ও যোগ্যতার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কলেজের নাম আরো উজ্জ্বল করবে। আড্ডা, খোশগল্প, গান, কবিতা আর বন্ধুদের সাথে খুঁনসুঁটিতে এভাবে হাসি-আনন্দে পার হয়ে যায় একটি দিন। যেদিন টি লালমাটিয়ার ভিত্তি গড়ার দিন। যেদিন সুবর্ণ জয়ন্তীর দিন। অর্ধশতক স্পর্শ করার দিন।