হত্যাকান্ডের শিকার অধিকাংশই শিক্ষাবীদ

আজ ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী যখন নিশ্চিত পরাজয়ের দারপ্রান্তে। তখন তারা মরণ কামড় নেয়ার নেশায় মেতে উঠলো। লেজ গুটিয়ে বিদায় নেয়ার আগে সোনার বাংলাকে মেধাশূণ্য করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করলো নরপিশাচরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, সাংবাদিক, ক্রিড়াবীদসহ নানা শ্রেনী পেশার দায়িত্বশীল মানুষগুলোকে তারা আটক করে হ্ত্যা করতে শুরু করে। ৭১এর এই দিনে আসন্ন বাংলাদেশ হারায় তার অগণিত মেধাবী প্রাণ, হারায় সহস্র শক্ত ভিত্তিপ্রস্থর। যাদের উপর ভর করে স্বাধীন বাংলাদেশ হতে পারতো আরো শক্ত সামর্থ্য। সেই দিনের শোকগাঁথা আজো বয়ে বেড়ায় এ জাতি। স্মরণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের মহান নিদর্শন মনে রাখতে, তাদেরকে সম্মান জানাতে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর দেশজুড়ে পালন করা হয় মহান শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

দেশের প্রতিটি সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা, স্কুলসহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। শোক শোভাযাত্রা, দোয়া মোনাজাত, পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ ধারন, দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ সহ নেয়া হয় নানা কর্মসূচী। বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের শিকার অধিকাংশই শিক্ষাবীদ ছিলেন। এক নজরে দেখে নিন….

বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা: বিভিন্নি তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, ২৫মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে সাথেই বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশাঁ তৈরী করে পাক হানাদাররা। এমনকি যু্দ্ধ চলাকালীন পাক সেনারা দেশের বিভিন্ন এলাকার বাঁছায় করে মেধাবী, শিক্ষাবীদ, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, গবেষক, সাংবাদিক, মেধাবী শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুক্তবুদ্ধিচর্চাকারীদের হত্যা করতে থাকে। নয় মাস যাবত এই হত্যাকান্ড চললেও চুড়ান্ত ও ভয়াবহ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে আজকের এই দিনে। তৎকালীন পাক সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মুল পরিকল্পনাকারী।

যা হয়েছিল সেদিন: ১৩ ডিসেম্বর সূর্যাস্তের পরেই ঢাকা শহরে পাক সেনাদের আগ্রাসন বেড়ে যায়। ভারী যানবাহন, ট্যাংকের হুংকারে কাপতে থাকে রাজধানী ঢাকা। এরপর শুরু হয় ধর-পাকড়। রাজধানীর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও বুদ্ধিজীবীদের আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসে পাক সেনারা। আটক বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকরা হয় নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে। ক্ষত-বিক্ষত করা হয় শরীর। হত্যা শেষে মাটি চাপা দিয়ে মুছে দিতে চায় রক্তের দাগ। এক রাতেই প্রায় কয়েক হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে পাকিস্থানী হায়েনারা।

হত্যার সংখ্যা: ১৯৭২ সালে জেলা ভিত্তিক শহীদ বু্দ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিয়ে একটি আনুমানিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাতে  ৯৯১ জন শিক্ষাবীদ, ১৩জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক ৪২জন আইনজীবী ও ১৬ জন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলীর হত্যাকান্ডের বিষয় উল্লেখ করা হয়।

ঢাকা বিভাগ: ১৩০ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৫৫জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১৭জন উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষক এবং ১০জন আইনজীবী হত্যাকান্ডের শিকার হন।

Post MIddle

চট্টগ্রাম বিভাগ: ১৩৮জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৭৩জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১৩জন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ১০ জন আইনজীবী হত্যার শহীদ হয়েছেন।

খুলনা বিভাগ: ১৮৪জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৮১জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের,  ১৫জন উচ্চ মাধ্যমিকের ও ৬জন আইনজীবী প্রাণ হারান।

রাজশাহী বিভাগ: ১৮৭ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৬১জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১৪জন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ১৫জন আইনজীবী শহীদ হন।

এছাড়া শুধুমাত্র ১৪ ডিসেম্বর রাতে  এছাড়া স্বনামধন্য সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, গীতিকার, সমাজসেবক, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিককে হত্যা করে পাক হায়েনারা।

তবে পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় এক হাজার শিক্ষাবীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের দিন প্রাণ হারান। এর মধ্যে ২৩জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ও ৩জন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন।

৭১এর এই দিনে পাক নর-পিশাচরা যখন বুঝতে পারে যে তাদের পরাজন আসন্ন। তখনই তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার মাধ্যমে উদীয়মান স্বাধীন বাংলাদেশকে মেধাশূণ্য করার হীণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। রাতের আধাঁরে হত্যাকরে সোনার ছেলেদের। হত্যার পর রাজধানীর রায়েরবাজার, মীরপুর, রাজারবাগ বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে মেধাবী প্রাণের সারি। এভাবেই বিশ্বের ইতিহাসে পাকিস্থানী হানাদাররা রচনা করে এক নির্মম হত্যাযজ্ঞের কালো অধ্যায়। ওরা ভেবেছিলো এভাবেই দমিয়ে দেয়া যাবে বাংলাদেশকে। এভাবেই ধ্বংস করে দেয়া যাবে বাঙালীর অস্তিমজ্জাকে। আমরা আজ মনেকরি, ওদের ধারণা ভুল ছিল। ওরা সেদিন পারেনি। ওরা আজও পারেনি, আগামীতেও পারবে না। রক্তের দাগ মুছে যেতে পারে, কিন্তু রক্তের ফল আসবেই। রক্ত কখনো বৃথা যায়না, যায়নি, যাবেও না। ১৯৭১এর আজকের এই দিনে যে প্রাণ ঝরেছিলো তা ভাল থাক ওপারে, অনেক ভাল। স্বমহীমায় উজ্জ্বল থাক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। ওই রক্তের উপর ভর করে “এগিয়ে যাক বাংলাদেশ”।

পছন্দের আরো পোস্ট