গৌরব ও অহংকারের প্রতীক যশোর জিলা স্কুল

th_small76পাক ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যশোর জিলা স্কুল। যশোরের রানী, রাজা আর কয়েকজন বিদ্যানুরাগী ১৮৩৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠাকালে স্কুলটির নাম ছিল যশোর মডেল স্কুল। ১৭৮ বছরের পুরানো ঐতিহ্যের স্কুলটি যশোর শহরে গৌরব আর অহংকার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

বৃটিশ শাসন আমলের আগে সুলতানী ও মোঘল শাসনের সময় যশোর অঞ্চলে হাতে গোনা কয়েকটি পাঠশালা, চৌপাড়ি ও টোল ছিল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নামতা, শতকিয়া, কড়াকিয়া, কাঠাকালি, বিঘাকালি, কিংবা কখনও কখনও কাব্য ব্যাকরণ শিক্ষা দেওয়া হতো। এ শিক্ষা পদ্ধতি ছিল মুখে মুখে। বৃটিশ শাসনামলে সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে এই শিক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে।

১৮২৮ সালে ভারতবর্ষের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন বৃটিশ শাসক লর্ড বেন্টিক। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ লাভের জন্য বঙ্গদেশে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। এ সময় বিদ্যানুরাগী নন্দী পরগনার জমিদারের স্ত্রী রানী কাত্যায়নী, রাজা বরদাকণ্ঠ, রাজা কালীকান্ত পোদ্দার, রাম রতন, মো. আব্দুল করিম, মৌলভী মো. আব্দুল্লাহ, নীলকমল পাল চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কুঞ্জলাল ঠাকুর, প্রাণনাথ চৌধুরী, শুকদাস রায়, রাধামোহন ঘোষ চৌধুরীসহ কয়েকজন বিদ্যানুরাগী এগিয়ে আসেন।

তাদের আন্তরিক চেষ্টা ও আর্থিক সহায়তায় ১৮৩৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি স্থাপিত হয় যশোর জিলা স্কুল। রানী কাত্যায়নীর কাছারি বাড়িতে ১৩২ জন ছাত্র নিয়ে স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। ওই বছরই সরকারের পক্ষে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্কুল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা জারি করেন। ১৮৪৫ সালের ২৭ জানুয়ারি রানী কাত্যায়নীর বার্ষিক ৩শ’ টাকা অনুদান ঘোষণায় স্কুলটি প্রাণ ফিরে পায়।

১৮৭২ সালে রানীর কাছারি বাড়ি থেকে যশোর মডেল স্কুলকে খড়কি মৌজায় স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরই স্কুলের নাম পরিবর্তন করে যশোর জিলা স্কুল রাখা হয়। পরবর্তীতে খড়কি মৌজার ৭.৮০ একর জমির উপর স্কুলের পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে মুজিব সড়কের পশ্চিম পাশে নতুন পুরাতন ১০টি ভবন নিয়ে জিলা স্কুলের গৌরবদীপ্ত অবস্থান।

Post MIddle

মোটা পিলারে ইতালীয় স্থাপত্য শৈলীতে রাজবাড়ির রাজকীয়তায় ভবনটি গড়া হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলো ১৯৮৬-৮৭ সালে যশোর জিলা স্কুলের ইতালীয় স্থাপত্য শৈলীর ঐতিহাসিক প্রশাসনিক ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবনটি ভেঙে ফেলার কারণে সু্কলের মর্যাদাহানি ঘটেছে।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর জে. স্মিথ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। যশোর জিলা স্কুল নামকরণের পর স্কুলের কলেবর বাড়ে। ১৮৭৪ সালে ছাত্রদের জন্য ফরাসি বিভাগ চালু করা হয়। স্কুলের মূল ভবনের দক্ষিণে ১৯০৭ সালে নির্মিত হয় হিন্দু হোস্টেল। ১৯১২ সালে উত্তর দিকে নির্মাণ করা হয় মুসলিম হোস্টেল। ১৯৪০ সালে হোস্টেল দু’টিকে দ্বিতল ভবনে রূপান্তরিত করে শ্রেণিকক্ষ হিসেবে চালু করা হয়।  ১৯৪৭ সালে চালু করা হয় উর্দু বিভাগ। ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞান ও মানবিক এবং ১৯৬৫ সালে বাণিজ্য বিভাগ চালু করা হয়।

ভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, কথাশিল্পী আনিস সিদ্দিকীসহ খ্যাতিমান পণ্ডিত ব্যক্তিরা এ স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধা গোবিন্দ চন্দ, ভাষা সৈনিক আলমগীর সিদ্দিকী, মোহাম্মদ সুলতান, বিমল রায় চৌধুরী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আব্দুল হাই, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ড. শমসের আলী, মোহাম্মদ শরীফ হোসেন, কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক, শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন, রাজনীতিক শহীদ মশিউর রহমান, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো, সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, পীর হয়রত মাওলানা শাহ আব্দুল মতিন, মেজর জেনারেল(অব.) জামিল ডি আহসান, সাবেক সচিব তসলিমুর রহমান, মনিরুজ্জামান, গীতিকার সুরকার মো. রফিকুজ্জামান, লেখক গবেষক আমজাদ হোসেন প্রমুখ মহিয়ান ব্যক্তি যশোর জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র।

মুক্তিযুদ্ধে স্কুলের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্র জীবন উত্সর্গ করেছেন। এরা হচ্ছেন সিরাজউদ্দিন হোসেন, মাশুকুর রহমান তোজো, আসাদুজ্জামান আসাদ, সিরাজুল ইসলাম শান্তি, নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমুখ।

যশোর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক একেএম গোলাম আযম জানান, স্কুলের লাইব্রেরিতে প্রায় ৬হাজার বই রয়েছে। নিয়মিত ম্যাগাজিন প্রকাশ, বিজ্ঞান চর্চা, খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বৃক্ষ রোপণ, স্কাউট, রেডক্রিসেন্টসহ স্কুলটিতে নানা ইতিবাচক কার্যক্রম চালু রয়েছে।

বর্তমানে দুই শিফটে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলে ২ হাজার ২৬ জন ছাত্র রয়েছে। শিক্ষক  রয়েছেন ৫০ জন। পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসিতে গত তিন বছর ধরে স্কুলের পাসের হার শতভাগ।

পছন্দের আরো পোস্ট