আকাশে ওড়ে স্মৃতির কবুতর । জাহান রিমা
নানুবাড়িতে প্রতি রাতে চোর আসে, টুপ টুপ করে টিনের ওপরে। ভয়ে আমাদের ছোট্ট শরীর আরও ছোট হয়ে যায়। জবুথবু হয়ে আরও কিছু উষ্ণতা পেতে ভয়ের দোহাই দিয়ে আমরা নানুকে জড়িয়ে রাখি। নানাভাই হেডমাস্টারের মতো গলা খাঁকরিয়ে বলে ওঠেন, শিশির শিশির! সাগরে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়? নানাভাইয়ের ঘন গলার স্বর। নানু ধমক দিয়ে বলেন, রাখো তোমার হেডমাস্টারগিরি, স্কুলে কইর, বাড়িতে না। নানুর কী সাহস! হেডমাস্টারকে ভয় করেন না।নানাভাই আস্তে করে কী যেন বলেন। নানু শুনতে পান না। আমরা পাই, হায়রে আমার ঘরের হেডমাস্টার রে! বিয়ে করলাম ছাত্রী মতন, এখন দেখি সে প্রিন্সিপাল!
নানুবাড়িতে বারো মাস শীতকাল। পৌষ আর মাঘ দুই যমজ বোন নানুবাড়িতেই থাকে। নয়তো প্রতি বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমরা যখনই বেড়াতে আসি তখনই কেন গোসল করতে কষ্ট হয়! দূরের টমেটো খেত দেখতে পাই না। কুয়াশা টকটকে লাল টমেটোতে আদর বসিয়ে রাখে। লাল শাকের মাথায় শিশিরের টোপর টলমল করে, যেন লজ্জা রাঙা সোনা বউ! একটু ছুঁয়ে দিলেই ঝর–ঝর–ঝর। এই সময় নানুবাড়ির বিয়ে দেওয়া অন্যসব খালামনিরা নাইওর আসেন।
আমাদের বিস্ময় কাটে না। নানুবাড়িতে সবাই কেন খালামণি আর মামা হয়? ছোট বেলার বিষ্ময়রা বড় বিস্ময়কর। কীসে যে বিস্ময় হয় আর কীসে যে হয় না! নানুর কোলেই রাত বাড়ে। আমাদের মন খারাপ হয়। আম্মু কখনো আসেন না। আমাদের নানুবাড়িতে দিয়েই চলে যান। চাকরিজীবী মায়েদের নাইওর থাকে না। আচ্ছা, আম্মু আসলে কী নিজের বাড়িতে ছোট্ট মেয়ের মতো দুষ্টামি করত? নানু কী, কুসুম এই সব করবি না বলে বকা দিতেন। এই সব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে একটা শব্দ শুনতে পাই। নানুবাড়ির টিনের দোতলা থেকে আসে। কী ভয়ংকর কথা এত রাতে ওখানে কে! পরক্ষণে শুনতে পাই সেখান থেকে গায়েবি আওয়াজ ভেসে আসছে, কুলুক কুলুক! আমাদের গরম লাগতে থাকে। নানুকে বলি, নানু গরম লাগে, বাইরে থেকে একটু বাতাস খেয়ে আসি! আর তখনই দোতলার ওপর থেকে ঝুম করে একটা গুঁড়া মামা আমাদের সামনে পড়েন! আয়ো রিমা, রিপা, আমরা পলান্তি খেলমু! বাইরে কী চান্নি রাইত।
বাইরে কাকডাকা জোছনা। একপাল ছেলেমেয়ে উঠোন জুড়ে। হই হই, রই রই করে আমরা সবে লুকোচুরি খেলি। খেলতে গিয়ে চোর পেলে দিই এক চিল্লানি। তার সঙ্গে উঠোনের দক্ষিণ কোণের নব্বই বছরের একটা নানু দেয় আরেকটা চিল্লানি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠেন, ইবলিসের দল অগল তো দেখি একটু ঘুমাইতেও দিব না! লুকোচুরি খেলতে খেলতে আমরা খড়ের গাদায় ঢুকে পড়ি। কেউ আমাদের পাবে না, কেউ না। ও মা! আর তো খড়ের ভেতর থেকে উঠতে পারি না। সারা গা চুলকায়। হঠাৎ কুলুক! পাইছি রে পাইছি বলে সবগুলা মামা আর খালামণি খড়ের মধ্যে ধুম করে শুয়ে পড়ে।
এবার আমরা আর লুকোচুরি খেলি না। গল্প গল্প খেলি। রহস্যময় সব গল্প। ওই দিন নাকি গুঁড়া মামা একটা শালুক ধরেছেন, শালুক তারে নিজ মুখে মামা ডাকছে! আমাদের বিস্ময় কাটে না। সত্যি মামা? মামা একটা রহস্যময় হাসি দেন, বুঝে উঠতে পারি না। এবার ছোটন খালামণি বলেন, আইচ্চা, তুমরা কী বলে টাওনের মানুষেরা পেম (প্রেম) করো সবাই? আমরা লজ্জায় লাল হয়ে যাই। কে বলেছে এই সব পচা কথা? যেন প্রেম করা একটা অন্যায়, মুখে উচ্চরণ করলেই, সে ভালো না, পচা। তখনই চাঁদের ওপরে এক টুকরো মেঘ উড়ে আসে, এই প্রসঙ্গ হারিয়ে যায়।
তারপরে লুঙ্গি মামা বলে ওঠেন, আচ্ছা, তোমরা কী বলে চড়ুই পাখির বাসাত থাকো? আমরা মন খারাপ চোখে উত্তর করি, তোমরা ইটের বাসাকে চড়ুই বাসা বলো কেন?লুঙ্গি মামা বলেন, ওইহানে যে পাখি থাকে! পাখি তো ভেন্টিলেটরে থাকে। এই কথা না শুনেই মামা এক লটকনে জাম গাছে। আমরা হা করে তাকিয়ে থাকি। লুঙ্গি মামা কত কী পারেন, বাব্বা! লটকন থেকেই লুঙ্গি মামা আবার বলেন, আইচ্চা, তুমরা যে প্যান্ট শার্ট পরো তুমাদের শরম নাই? আমি আর রিপা একজন একজনের দিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব গুন্ডা গুন্ডা ভাব নিয়ে বলি, প্যান্টের মইধ্যে খেতের ডাল, না থুক্ক ডাইল রাখা যায়। তার জন্য পরি। হি-হি-হি-হি এইতেরা মইধ্যেরে মইধ্যে বলে বলেই লুঙ্গি মামা একলাফে আবার মাটিতে পড়েন।
আরে ওইখানে ওইখানে কে? চাঁদের আলোয় ঝাপসা কে যেন আসছে, কাছে আসতেই বুঝি ইটা তো নানু। নানু ধুম করে এসে আমাদের খড়ের ভেতর থেকে ধরে নিয়ে যান। যে পুকুরে কেউ না থাকলে অজগর সাপ ডিম পাড়ে সেটার মধ্যে নামাতে নামাতে বলেন, ই ছি-ছি-ছি, পুরা গায়ে ময়লা। খ্যাড়ের ভেতরে এত রাতে মানুষে যায়? এরে তোরা জ্যাকেট খুলচস এই শীতে? তোদের কি একটুও ঠান্ডা গরম নাই? হারামি অগল, তোর দাদী দেখলে খাইব আমারে। বইলব, নানার বাড়িত পাঠায় আমার নাতিনগুলারে অসুখ বান্ধালাইছে! আমরা হাত–পা ধুয়ে ঘুমাতে যাই। তাতেই রাত বাড়ে।
হাজার বছরের পুরনো সেই রাত। দূর, বহুদূর থেকে পালা গানের সুর ভেসে আসে, তুই যদি আমার হইতি রে, আমি হইতাম তোর; কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর…। কার কণ্ঠ থেকে এত দরদ ভেসে আসে তা আর দেখা হয় না, জানাও হয় না। গ্রাম-গঞ্জে রাতের আঁধারে কাদা মানুষগুলো দিন হলে আর দেখতে পাই না। দুঃখ এমন গোপন বুঝি। রাত ভোর হয়, গাছের ফাঁকে ঝলমলিয়ে ওঠে সকালের সোনা রোদ। আমি চোখ মেলে দেখি, আজ আমার পরীক্ষা শেষ।
পরীক্ষা শেষ হলে এখনো নানু বাড়ির মতো আনন্দ হয়,কিন্তু আর নানু বাড়িতে যাওয়া হয় না। নানা ভাই মাটিতে পেতেছে শয্যা, নানুর সাদা শাড়ি জুড়ে সেই আতরের ঘ্রাণ। কী তীব্র! আমি জানালায় চোখ রাখি, আকাশে ওড়ে স্মৃতির কবুতর। কফি কাপে পুড়ে যায় ঠোঁট। #
- জাহান রিমা। ভ্যালেন্সিয়া কলেজ ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।