গবেষণা গ্রামের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে। শেকৃবি উপাচার্য

আধুনিক কৃষি শিক্ষার মাধ্যমে এদেশের কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৩৮ সনে প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটের রূপান্তর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এর বয়স ১৫ হলেও, কৃষি উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসাবে এর রয়েছে সুদীর্ঘ ৭৮ বছরের ঐতিহ্য। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মূলত উপমহাদেশের কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য হলেন এগ্রিকালচারাল বোটানী বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ। সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন, ২০০১ এর ১০(১) ধারা মোতাবেক অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদকে ৪ বছরের মেয়াদে নিয়োগ দেন। কৃষি শিক্ষা ও গবেষণাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয়ে তার সাথে কথা বলেছেন বশিরুল ইসলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যে বিষয়গুলোর উপর বেশি নজর দিবেন?
উপাচার্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে তিনটি শব্দ রয়েছে গবেষণা, শিক্ষা, সম্প্রসারণ। এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি গবেষণা হবে। আর সেই গবেষণা গ্রামের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এরকম একটা লক্ষ্য নিয়েই আসলে এগিয়ে যেতে চাই। তাছাড়া সুদক্ষ মান সম্পন্ন জনবল তৈরি করা যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক শিক্ষা প্রদান করতে পারে। সে সাথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা যাতে সঠিক শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ তৈরি হয়। একাডেমিক দিকে অনুষদ সংখ্যা বৃদ্ধি, সীড টেকনোলজি ইসস্টিটিউটকে ঢেলে সাজানো, শিক্ষায় নতুন ধারা উন্মোচন, সিলেবাসে আধুনিকতা সংযোজন করা।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চতর কৃষিশিক্ষাকে কেন গুরুত্ব দেয়া উচিত ?
উপাচার্যঃ কৃষিই কৃষ্টির মূল। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আমরা যতটা উন্নতি করি না কেন, খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানোর জন্য আমাদের বারবার ফিরে যেতে হয় কৃষি ও কৃষকের কাছে। আর এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ও কৃষিবিদরা। কৃষিতে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণকারীদের দেশের উন্নয়নে সরাসরি অংশগ্রহনের সুযোগ রয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কৃষি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সার্বিক গুনগত মান সর্ম্পকে আপনার মূল্যায়ন কি?
উপাচার্য : শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুনগত মান অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক ভাল বলে আমি মনে করি। বিশ্বমানের একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে আমরা সেমিস্টার সিস্টেম চালু করেছি অনেক আগেই- এর সুফলও ছাত্রছাত্রীরা পাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা বিষেষ করে নবীন শিক্ষকরা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় স্কলারশিপ পাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি সংস্থার গবেষণা সহায়তাও বাড়ছে। কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকা-ের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিদেশি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।

ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার বিশেষজ্ঞরা, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বিজ্ঞানী ও গবেষকরা শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। চীন,কোরিয়া জাপানের কয়েকটি দেশের সাথে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুযোগ বাড়াতে ক্যাম্পাসে ইতিমধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার স্থাপিত হয়েছে। ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্নপদক’ প্রব’র্তনের পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এই সম্মাননা পেয়েছেন। এসবই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানেরই স্বীকৃতি। আমি আশা করি সময়ের সঙ্গে এ মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সেশনজটমুক্ত। আর এর পিছনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলের অবদান রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে কী কী অন্তরায় আছে?
উপাচার্য : বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে তেমন কোনো অন্তরায় নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকের সভায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৩শত ৫২ কোটি ৬৮ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১ এপ্রিল ২০১৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ সাল পর্যন্ত। তবে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা সব প্রতিষ্ঠানেই আছে। এর মধ্যেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের অগ্রগতি সন্তোষজনক। বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকেই এখানকার শিক্ষার্থীরা পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ভালো চাকরি পাচ্ছে। কৃষি সেক্টরের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।

Post MIddle

বর্তমান সময়ে কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে কোন বিষয়ে গুরুত্বরোপ করা উচিত ?
উপাচার্য : কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে যে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা উচিত তা হলো, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈরি আবহওয়া ও জলবায়ু, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, বিভিন্ন উদ্বূত সমস্যা নিরসনের জন্য কার্যক্রম, কৃষি নির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা, বিভিন্ন রকমের কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাত প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন সমস্যা উত্তরণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় কৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণির জাত উদ্ভাবন। সর্বোপরি উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন নিশ্চয়তা করার লক্ষে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার মধ্যে একটি শ্যামল গ্রাম। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বাড়াতে কি ধরনের পদক্ষেপ নিবেন ?
উপাচার্য : বর্তমানে যে সৌন্দর্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে, তাকে আরো সম্পদশালী, সৌন্দর্যশীল করার লক্ষে অর্থের বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এক অসাধারণ সৌন্দর্যশীল ক্যাম্পাসে পরিণত হবে। এই বিশ্বাস আমার রয়েছে।

01অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী :

১৯৫৭ সনের ১ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলা বিজয় নগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মেদ। শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে ড. কামাল উদ্দিন অনন্য মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৬৯ সনে গণ আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে ১৯৭২ সনে এসএসসি ও ঢাকা বোর্ডের অধীনে ১৯৭৪ সনে এইচএসসি পাশ করেন। বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) অধীনে তিনি ১৯৭৯ সালে বি.এসসি.এজি ও ১৯৮২ সালে এম.এসসি, যুক্তরাজ্য থেকে ১৯৮৭ সালে এম.ফিল এবং ২০০৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ ১৯৮১ সনে তৎকালীন বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এগ্রিকালচারাল বোটানী বিভাগে প্রভাষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।

তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার এন্ড টেকনোলজি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, যশোর বোর্ডসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষক, ভিজিটিং শিক্ষক, শিক্ষক ও বিজ্ঞানী নিয়োগ বোর্ড বিশেষজ্ঞসহ নানাবিধ একাডেমিক ও গবেষণামূলক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।

অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ ভুট্টা, গম ও ধান ফসলের উপর বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইউরোপিয়ান কমিশন, ইউএস এইড, বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ০৭টি বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর ৩৯টি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিভিন্ন সাময়ীকিতে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর অপ্রকাশিত বহু গবেষণা কর্ম রয়েছে।

অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ শিক্ষা, গবেষণা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষক সোসাইটি কর্তৃক অমর একুশে ২০১২ পদক প্রাপ্ত হয়েছেন।

পছন্দের আরো পোস্ট