একটু ভিন্নভাবে ভাবলে দোষের কি !। মেহেরুননিসা জোবাইদা

%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a8%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a6%b8%e0%a6%be-%e0%a6%9c%e0%a7%8b%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a7%8d%e0%a6%87%e0%a6%a6%e0%a6%beঅনেকে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন আমি পত্রিকায় লিখিনা কেন। পত্রিকায় লেখার আমার অভিজ্ঞতা ঠিক অন্য লেখকদের মতো হয়নি। সবাই পত্রিকায় লিখে খুশি হলেও আমি যতবারই পত্রিকায় লিখেছি ততবারই বিব্রত হয়েছি। হয় লেখার মধ্যে কোথাও কোন বানান ভুলসহ ছাপা হয়, নয়তো এডিটের নামে কোন একটা গুরুত্বপূর্ন কথা গায়েব হয়ে যায়। সবচেয়ে বেশি বিব্রত হয়েছি নিজে পত্রিকার খবর হয়ে।

জীবনে প্রথমবার পত্রিকার খবর হই তাহের সাহেবকে বিয়ে করে। ঢাকা সিলেট মিলিয়ে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় (কম/বেশি) গুরুত্বসহকারে খবরটি কোথাও না কোথাও ছাপা হয়। বিয়ের ছবি দিয়ে সাদামাটা খবর, অনেকটা প্রেস রিলিজের মতো। তারপর সিলেটেই প্রথম আমার কথাকে কোট করে খবর ছাপা হয়। জীবনের সেই প্রথম অভিজ্ঞতা খুব একটা খারাপ ছিলোনা যতক্ষন না ছাপার অক্ষরের পত্রিকাগুলো নিজে না পড়েছি। অন্য সবাই খুশি হলেও আমার মনে হচ্ছিল – ছি ছি কী লজ্জা! এসব আমি কখন বল্লাম!

হ্যা। লজ্জাকর কথাই ছাপা হয়েছে। সবার জন্য না। আমার জন্য ছিলো। সেই ১৯ বছর বয়সের টনটনে রুচিতে বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছিলাম জীবনের প্রথম খবরে উদৃত হয়ে।

১৯ বছর যাদের বয়স বা ১৯ বছর পার করেছেন আপনারা জানেন এ বয়সের অনুভূতি। জগত জয়ী অনুভূতি। পৃথিবীকে পায়ের তলায় রেখে হাটার অনুভূতি। অনেকে এ বয়সে খুব রোমান্টিক হলেও রোমান্টিকতা আমার ঠিক ডিকশনারীর বাইরে বরাবর। জগত ছিলো ইন্টেলিজেন্ট, স্মার্ট আরগুমেন্টের। যুক্তি তর্কের কাটাকাটি হবে নিনজাদের তলোয়ারের চাকচিক্যের মতো। প্রেম যেহেতু আবেগের বিষয়, আরগুমেন্টর না, সেই ছেলেবেলা থেকে মনে হয়েছে প্রেম খুব অসস্তির- হোক সে অবিবাহিত বা বিবাহিত প্রেম।

পারিবারিক পরিবেশও প্রেমের পক্ষে ছিলোনা। বাবা বা মাকে জীবনে একবারের জন্যও কোন ”রোমান্টিক” ডায়ালগ দিতে শুনিনি। এলাকায় কারিতাস নামে জার্মানির এটা সংগঠন এসেছিলো। সবাইকে কারিতাসের মানে শিখাতো, “প্রেম. ভালোবাসা”। পিঠেপিঠি ছোটরা সব সময় কেমন বান্দর টাইপ হয় জানেন তো। আমার ছোট বোনটা আমার দুর্বল পয়েন্ট জানতো। তাই ক্ষেপাতে হলেই আমাকে বলে উঠতো, ”মেরী আপু কারিতাস প্রেম ভালোবাসা…” আর যায় কোথা। গগন বিদারী ঝগড়ার জন্য অন্য কোন উপকরন আর লাগতোনা। চিৎকার, মারামারি, মায়ের কান ঝালাপালা এবং সর্বশেষ কথা বন্ধ সপ্তাহ দুইয়ের জন্য।

অনেক গল্প উন্যাস পড়ার কারনে প্রেম সম্পর্কে বেশ ভালোই জেনেছি। সবচেয়ে নীচু মানের গল্পের বই যাতে প্রেমের কথা রাস্তার সিনেমার মতো মনে হতো, তার ডায়ালগে প্রেমের ( সফল)পরিনতিতে প্রেমিকা বা প্রেমিক বলত, “তোমাকে পেয়ে আমার জীবন পূর্ন হয়েছে..”। হ্যা এমনইতো মনে হয়েছে। আর ১৯ বছর বয়সে আমকে কোট করা হলো আমি নাকি বলেছি, তাহের সাহেবকে বিয়ে করে ”আমার জীবনের পূর্নতা লাভ করেছি” ছি! কি ছোটলোকি কথা! বিয়ে করে কেন জীবন পূর্নতা পাবে? জীবন কি এত ছোট জিনিস???

Post MIddle

14908352_10153987090485095_846929007725020320_nযাই হোক, বিয়ের পরে ভদ্রলোক কেবল একমাস সময় ছিলেন। এমন অরুচিকর কোট না পড়লে সময়গুলো হয়তো আরেকটু ভালো কাটতে পারতো। ওই একটি মাত্র কোটের কারনে উনাকে দেখলে গা রি রি করে উঠতো। উনাকে কোনদিনও বলা হয়নি। আপনাদেরই আজ প্রথম বল্লাম।

এর পরে যতবারই খবর লিখেছি বা খবরের অংশ হয়েছি- ততবারই অভিজ্ঞতা আমার বিপরীতে কাজ করেছে। ফলে কোথায় খবরটি  নিয়ে খুব খুশি হয়ে আর দশজনকে দেখাবো কিনা উল্টো মনে হয়েছে, যদি পৃথিবীর কেউ না দেখতো খবরটি!

সর্বশেষ যে খবরটির উদৃত হলাম সেই খবরে আমার অনুভূতিই উল্টে গেলো। যে কথা বলতে চাইনি তা ই লেখা হয়েছে। যে কথা বলতে চেয়েছি খবর তার উল্টোটা ছাপালো। এমনকি শিরোনাম থেকেই শুরু। ফলে পুরো খবর না পড়ে প্রথম কয়েক লাইন পড়ে কেটে দিয়েছি। অন্তত নার্ভগুলো কর্মক্ষম থাকুক।

লোকে বলে অনেক ভালোবাসা বিপদের কারন। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। আমার অনেক অসঙ্গতি আছে। আমি অন্য সবার মত চিন্তা করিনা। কিন্তু মানুষরা তারপরেও আমাকে ভালোবাসে। আর সাংবাদিকরাও তো মানুষ। ফলে, যখন তারা আমার কথা কোট করে, সেখানে তাদের যতটুকু ভালো লাগে বা মনের মতো হয় ততটুকু নিয়ে বাকীটা আপন মনের মাধূরী মিশিয়ে আমার নামে চালিয়ে দেয়। বিষয়টা যে ক্ষতি করার জন্য তা নয়- আমাকে আরো ভালো করার জন্য। কিন্তু ততক্ষনে আর সেই মানুষটা আমি থাকিনা- আমি নিজেই চিনতে পারিনা সেই বক্তব্যকে যা আমার মুখ থেকে বের হয়েছে বলা হয়।

যাই হোক, লেখক হিসাবে আমি যেমন তেমন, মানুষ হিসাবে আমি খুব একগোঁয়া। আমি পাল্টাইনা যতক্ষন আমার চিন্তা এবং বিশ্বাস না পাল্টে। একজন সাংবাদিক আমার কথা তার মতো করে লিখে দিবে এটার জন্য আমি ওই সাংবাদিকের সাথে যুদ্ধে জড়াইনা, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হই।

10363650_10152786957675095_8188942387639552957_nকলেজে আমার একটা কোর্সের নাম ছিলো ক্রিয়েটিভ রাইটিং। প্রতিদিন একটা করে গল্প বা কবিতা লিখতে হতো। আন্ডার প্রেসার। এমন কঠিন সময়েও আমার যা মনে হতো আমি তেমন করেই লিখতাম। প্রফেসর এবং অন্য সহপাঠীরা আমাকে অনেক কিছু বদলে জমা দিতে বলতেন, কিন্তু আমার কথা ছিলো সেটাতো তাহলে আমার মতো করে ভাবা হলোনা, দেখা হলোনা। মনে হয় অনেকটা বিরক্ত হয়েই প্রফেসর গ্রেড থেকে এক নচ কমিয়ে “এ” মাইনাস দিয়েছিলেন। তারপরও দুঃখ নেই। বাংলাদেশেও কোনদিন কোন পরীক্ষায় পূর্ন নম্বর পাইনি। কোন কোন পরীক্ষায় টানে মানে পাশ করেছি- ওই একটি কারনে। অন্যের নোট বা বাজারের লেখা মুখস্ত করে লিখতে রাজী হইনি বলে। আমার লেখা সব সময় আমার মতো; হয়তো অতটা ভালো নয়- কিন্তু আমার মতো। পৃথিবীর একটা মানুষ একটু ভিন্নভাবে ভাবলে দোষের কি এতবড় পৃথিবীর!

মেহেরুননিসা জোবাইদা। উপস্থাপিকা,পরিচালক,প্রযোজক ও প্রতিষ্ঠাতা প্রোগ্রাম ম্যানেজার,টাইম টেলিভিশন.নিউইয়র্ক

পছন্দের আরো পোস্ট