হৃদনেত্র দিয়ে দেখি উচ্ছ্বসিত সেই ক্ষণ…..

আমি অতল আকাশ পাড়ি দিয়ে এসেছি। রাত এসে আঁধারের ঠোঁটে জড়াল। তাতেই সমুদ্রসম আবেগে দুই মহাদেশ এক করে ফেলা আদম–হাওয়া। ভোর এসে দরজায় দাঁড়িয়ে। সূর্য সামনে আসতেই আমি শুরু করলাম কান্না! আমার প্রিয়তম যখন বলল, তুমি বাসায় থাক, আমি যাই। যাই মানে কী! কই যাও, কোথায় যাও, কেন যাও? তার মানে কী আমি একা থাকব বাসায়?

মাথায় আমার আকাশ চূর্ণ হতবুদ্ধিতা। এক জীবনে একটা দিনের জন্যও একা না থাকা এই আমি আজ, এই মুহূর্ত থেকে একলা থাকব ভিনদেশে? এ যে মাথায় আসেনি একবারও। কী বোকা আমি। মানুষ পরিস্থিতিতে নিজে না পড়লে কখনো তা উপলব্ধি করতে পারে না। এমনকি ধারণাও না। আমিও পারিনি বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে। একা থাকবার এই ভয়ে গভীর অরণ্যে আমি যেন ভীত হরিণী। এই দেশে মানুষ বহু আছে। তবু কোথাও কেউ নেই। তারপর অনন্যোপায় হয়ে আমাকে সে বন্ধুর বাসায় রেখে যায়।

অতপর অপরিচিত মানুষের বাসায় আমার হঠাৎ আগমন। আমি অপ্রস্তুত কিছুটা। ছোটবেলায় যেমন ছিলাম, কারও বাসায় গেলে রিমোটটাও ধরা যাবে না। ওরা কী বলবে। এমন করেই কিছু সময়। আমাদের চা-পর্ব সমাপ্ত হলো। আমার আরও কিছুক্ষণ কাটাতে হবে এই সদ্য পরিচিত ঘরে। এই ভেবে শরীরটা এলিয়ে দিলাম ওদের অতিথি রুমে। ঠিক সেই তিথিতে আমার বরের বন্ধুর বউ, বীথি নামের মেয়েটাকে দেখলাম পড়ছে। সে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর করছে, ল্যাব সায়েন্টিস্ট। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অনেক কঠিন। কার না জানা। থাক পড়ুক। পড়াশোনা করতে নিলে টু শব্দ করতে নেই। এতে মনোযোগ নষ্ট হয়।

এদিকে হালকা শীতের রাত। একটা কাঁথার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার জন্য পড়তে বসা মেয়েটাকে ডাকা অনুচিত ভেবে আমি ঘুম। চোখ জুড়ে তন্দ্রা এল বোধ হয়। এমন সময় হঠাৎ আলতো ছোঁয়া। মেয়েটা আমার গায়ে শীতের কাঁথা জড়িয়ে দিল। আমি বুঝতে পারছিলাম। সম্পূর্ণ কাঁথা সে খুলে জড়িয়ে দিচ্ছিল গায়ে। এমন স্নেহের প্রবাহে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। এই দূর দেশে দেশের মায়া কোথা থেকে এল! অচেনা মানুষের সামনে ভালোবাসার জল গড়ানো ভারী লজ্জা বুঝি। আমি আড়াল করি। এত আবেগী হলে চলে? এই মেয়েটা ভেজা চোখ দেখে ফেললে কী ভাববে আমাকে।

সেই সেদিনের সে সব ভাবনা আজও স্মৃতির কাঁথায় জড়িয়ে। এখন এই একলা চলতে হয় ভুবনে একা থাকার মন্ত্র আমি জানি। একে উপভোগ করতে শিখে গেছি। কিন্তু একটিবারের জন্যও আমি সে স্নেহের পরশ ভুলিনি। মানুষ কখন, কাকে কী কারণে মনে রাখে কেউ তা জানে না। খুব ক্ষুদ্র জিনিস থেকেও মানুষের জন্য মানুষের জাগতে পারে তুমুল ভালোবাসা। অপরিচিত একটা মেয়ের প্রতি আরেকটা মেয়ের সেদিনের সেই উষ্ণ ভালোবাসার কোনো মূল্য আমি দিতে পারি না। পারি শুধু এটুক বলতে, অভিবাসী জীবনে সেই-ই আমার নতুন করে হওয়া প্রথম আপনজন।

Post MIddle

তারপরের গল্প অদ্ভুত। সে আমার মনস্তত্ত্ব বোঝে, আমি বুঝি তার মনস্তত্ত্ব। অতপর ছায়া সুনিবিড় বীথি আর ভুবনের গল্প ওয়াশ রুমে গিয়েও শেষ হয় না। যেন আমার শ্যামল গ্রামের শেওলা জমা পুকুর ঘাট পেয়েছি। আমরা বাথটাবে পা ডুবিয়ে বসে থাকি। বীথি আপুর শাশুড়ি আমার খালাম্মা তো খুঁজেও পান না, এরে কই গেলিরে তোরা!

তারপর থেকেই আমরা দুই সুহৃদ নিত্য গড়ি কথার প্রাসাদ।

ওমা! একদিন হঠাৎ দেখি বীথি আপুর রান্না ঘরে ছোট্ট একটা শিলপাটা। ঘরের ছোট সন্তান ছিলাম বলে কিনা জানি না। সব ছোট জিনিস আমার পছন্দ।
পছন্দনীয় কিছুর প্রশংসাতে কার্পণ্য করতে নেই। তাই আচ্ছা মতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম। বললাম, সখী গো জিনিসটা দারুণ! বীথি মেয়েটা মায়া দিয়ে গড়া। এক রাতে আবিষ্কার করি আমার বাসায় এসে চুপটি করে শিলপাটাটা রেখে গেছে মেয়েটা। আমি তো অবাক। বকা দেওয়ার জন্য ফোন করেছি। নাহ, সেই অন্যায়ের জন্য কিচ্ছু বলতে পারলাম না। শুধু অনুভব করলাম কিছু ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

এদিকে বীথি আপুর বাসার কাছেই আবার থাকেন এক দাদা-বৌদি। তাদের সঙ্গেও পরিচয়। দাদার বাসায় ছোট্ট একটা মানুষ এসেছে পরিবারের নতুন সদস্য পদ নিয়ে। কবুতরের মতো তুলতুলে ছোট্ট মানুষ। তাকে দেখতে গেলাম। সংসার করলে কত দায়িত্ব থাকে মাথায়। দাদা-বৌদির সদ্য জন্ম নেওয়া সেসমিথ মনাকে দেখতে গিয়ে মাথার কাছেই দেখি ছোট্ট একটা ভেসলিন। সুন্দরকে সুন্দর আর ভালোকে ভালো বলবার উদারতার কমতি আমার কোনো কালেই ছিল না। তাই আচ্ছা করে বলে আসলাম, আল্লাহগো…আদর লাগে এই ভেসলিনটার জন্য! তাৎক্ষণিক দাদা বললেন, নিয়ে যান না জিনিসটা। আরে ভারী মুশকিল। আমি কী সুন্দরকে সুন্দরও বলতে পারব না নাকি? না বলতে শিখেছি ইতিমধ্যে। না নিয়েই ফিরলাম বাসায়।

সপ্তাহ পর রাত ১২টায় দাদা আমার বাসায় হাজির। হাতে সেই আদর লাগুইন্না ভেসলিন। আমি হতভম্ব। এমন করে মানুষ? ঘরে আনা আন্তরিকতা আমি কী করে ফেরাই। নিলাম সানন্দে। সঙ্গে আমি বায়না ধরে বসলাম খেয়ে যেতে হবে দাদা। রাত তো অনেক, দাদা চলে যেতে উদ্যত। রান্না তেমন একটা নেই। এমন মানুষদের জন্য রান্না লাগে না। তবু দাদা অনুরোধ গ্রহণ করলেন। খেলেন। তৃপ্ত হলেন। হবেনই বা না কেন, ভাত ডালের আপ্যায়নেও আনন্দিত হতে জানা জটিলতাহীন গোত্রের মানুষ যে তারা।

অথচ আমরা সুযোগ পেলেই দূর আকাশের তারাদের গল্প বলি। গল্প যদি বলতেই হয় মনের আলোয় আলোকিত এই সব নির্মল মানুষেরা বিষয়বস্তু কেন নন? নাহ, আমি আজ বলতে চাই। আজও আমি প্রাপ্তির বারান্দায় এই দুটি মানুষকে দেখতে পাই। হৃদনেত্র দিয়ে দেখি উচ্ছ্বসিত সেই ক্ষণ। চোখময় ভেসে ওঠে সেই শিলপাটা আর সেই ভেসলিন। এই দুটি জিনিসের মূল্য কত? আসলেই কী আছে মূল্য? না, নেই। কিছু জিনিসের মূল্য হয় না। এসব তো অমূল্য। ভালোবাসারা এমনই জলের মতো আশপাশ জুড়ে থাকে; সহজ অথচ মূল্যবান।

পছন্দের আরো পোস্ট