এক চিল্‌তে সুখের উল্টো পিঠে কিছু গল্প থাকে..। রিমি রুম্মান

গতকালের কথা।
শীতের সকাল। আগের দিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হোল, টানটান উত্তেজনায় রাত জেগে ফলাফল জানলো শহরের মানুষজন। অথচ বাইরের জনজীবন ঠিক প্রতিদিনকার মতোই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক নেই শুধু প্রকৃতি। শহর জুড়ে অন্ধকার। হালকা বৃষ্টির মাঝে হাঁটছি ওয়েস্ট ফোর স্ট্রীট ধরে। একে একে পেরোচ্ছি এভনিউ নাইন, টেন … । অতঃপর নির্দিষ্ট ঠিকানার সামনে এসে দাঁড়াই।

ছাইরঙা ইটের দালান। সামনে প্রশস্ত ফুটপাতে ছাইরঙা একটি একলা কবুতর আর মাথার উপরেও সেই ছাইরঙা মেঘলা আকাশ। গেট পেড়িয়ে ইনফরমেশন ডেস্কে বসা নারীকে ফাইলটি বুঝিয়ে দিয়ে ফিরছি আমি আর আমার প্রতিবেশী এক দাদা।

আমরা দু’জনই এসেছিলাম আমাদের সন্তানদের হাইস্কুলে ভর্তির কাগজপত্র জমা দিতে। ট্রেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে হেঁটে যেতে যেতে দাদা পুরনো দিনের গল্প করছিলেন। সুউচ্চ বাড়িগুলোর মাঝে দু’একটি ছোট দোতলা পুরনো বাড়ি এখনো রয়ে গেছে। এখানেই পাঁচশো নয় নাম্বার বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালেন ক্ষণিক, যে বাড়িটিতে তিনি বসবাস করেছেন আজ থেকে অনেক বছর আগে। একটি মাত্র বাঙালি ব্যাচেলর পরিবার থাকতো বাড়িটিতে সেই সময়ে। বাদ বাকি সকলেই শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। বললেন, সেইসময়কার যাপিত জীবনের কথা। সাদারা কেবলই ম্যানেজমেন্টে অভিযোগ করতো জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় রত কিছু যুবকের বিরুদ্ধে। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা রোজ বাঙালি মশলাযুক্ত খাবার রান্না করে। রান্নার সেইসব গন্ধ এপার্টমেন্টটিতে ছড়িয়ে পরে। তাঁদের অপরাধ সারাদিন কাজের শেষে পরিবার পরিজনহীন এই শহরে বাড়ি ফিরে তাঁরা গল্পে মশগুল হয়, উচ্চস্বরে হেসে উঠে কিংবা শব্দ করে হাঁটে।

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝেও আমার বাড়ি ফিরবার তাড়া নেই। গল্প শুনছি। শুনতে শুনতে আমি যেন সেই সময়ে ফিরে যাচ্ছি। কারো পেছনের কালের গল্প শুনে, কেউ কি সেই সময়কে ধারন করতে পারে ? কিন্তু আমি যেন সেই সময়কেই ধারন করছিলাম। দাদা একটি সুউচ্চ দালান দেখিয়ে বললেন, এইযে দালান, এটি সেইসময়ে ছিল না। এখানে একটি পার্ক ছিল। একদল মাতাল এই পার্কটিতে জটলা করে থাকতো দিনভর। তিনি আঙুল উঁচিয়ে দূরে দেখালেন।

Post MIddle

তাঁকে অনুসরণ করে সেদিকে তাকাই। বললেন, ” ওই যে রাস্তার মোড়, ওইখানে বসে আমি বই বিক্রি করতাম কন্‌কনে শীতের দিনে, কখনো তুষারের মাঝে। আয়কৃত ডলার দেশে পাঠাতাম।” পুরনো সেইসব গল্প করতে গিয়ে তিনি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিলেন। হবেনই বা না কেন ! এই যায়গাটায় কেটেছে তাঁর বিগত সময়ের অনেকটাই। এখানেই যে মায়ায় জড়িয়ে থাকা স্ট্রীট, এভিনিউ, আর শ্যাওলা পড়া বাড়িটি।

তিনি এদেশে এসেছেন সাত এর দশকে। ১৯৭৭ সালে। স্টুডেন্ট ভিসায় এলেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি অর্থ সংকটে। অনেক চড়াই উৎরাই শেষে বৈধ কাগজপত্র পেয়েছেন। দুটো বাড়ি কিনেছেন। এখন পরিবার নিয়ে ভালো আছেন।

প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে টিকে থাকতে কতো মানুষ কতো ভাবেই না শ্রম দিয়ে যাচ্ছে ভিনদেশে। পরিবারের এক চিল্‌তে সুখের উল্টো পিঠে কিছু গল্প থাকে।সাহসী সেইসব মানুষদের গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন যদিও, কিন্তু আবেগে ভিন্নতা নেই কারোরই।

দেশে এবং প্রবাসে, ভালো থাকুন সকলে।

পছন্দের আরো পোস্ট