আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকেরা । জাহান রিমা

জোয়ার এসে আমাদের বাসা, পথ সব পানিতে টইটম্বুর করে ফেলেছে। টইটুম্বুর আনন্দে ঘরের ভেতরে পানিতে লাফাচ্ছি। জোয়ারে আসা পানিতে ঢেউ দিচ্ছি। মনের ভেতরও টইটম্বুর আনন্দ। কারণ প্রাইভেট স্যার আসতে পারবেন না কোমর ভেজা এত পানি ঠেলে।তখন ক্লাস ফাইভে আমি। ছোট ছিলাম বলে সোফার নিচে বসে টি টেবিলে পড়তাম। স্যার বসতেন সোফায়। কিন্তু জোয়ারের পানির কারণে ঘরের সোফা উল্টে রাখা হয়েছে খাটের ওপরে। সুতরাং অনুমান ফকফইক্কা, আজকে ছুট্টিই! স্যার আসতেই পারবেন না। কিন্তু সেই টইটম্বুর আনন্দে মুহূর্তেই ভাটা পড়ল যখন দেখলাম; এক কোমর পানি ঠেলে পড়াতে আসছেন স্যার! আমার স্যার।

আমাদের প্রিয় মোস্তফা স্যার। যিনি আমাদের শাসন করতেন বাবার চোখে। কোনো ক্লাসে নম্বর কম পেলে দুশ্চিন্তা করতেন মায়ের মতো। যার হাত ধরে লিখতে শিখা আমার আজকের এই বর্ণমালা। যাঁর সামনে গেলে এখনো চোখে জোয়ারের পানি আসে। ভয়ে না, শ্রদ্ধায়। যাঁকে সাফল্যের কথা বলতে গেলে আজও গলা ধরে আসে কৃতজ্ঞতায়।

শ্রদ্ধা জানাই আমাকে বর্ণমালা শেখানো আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মোস্তফা স্যারকে। তখন ক্লাস নাইনে আমি। দাদা, দাদা সম্বোধনের আত্মীয়তা ছিল স্যারের সঙ্গে। তিনি আমার শিক্ষক কালাম স্যার। তবে সে ডাকে টলত না তাঁর ব্যক্তিত্বের দাঁড়ি–কমাও। সম্পর্কের সূত্রকে তিনি শিক্ষকের সঙ্গের সমীকরণে মেলাতেন না। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পর্বত বুকে নিয়ে স্বজনপ্রীতি নামক শব্দকে নিঃশব্দ রেখে তিনি আজীবন পড়িয়েছেন শিক্ষার্থীদের। যাঁর কাছে ধনী আর দরিদ্র শিক্ষার্থীর তফাৎ ছিল মাইনাস শূন্যের কোটায়। গরিব ছেলেটাকে যিনি কাঁধে হাত দিয়ে বিনা মূল্যে প্রাইভেট পড়তে আসার টাইম বলে দিতেন টিফিনের ফাঁকে এই বলে, কিরে বিকেলে সময় নষ্ট না করে আমাকে সময় দিলেই তো পারিস। বিকেল তিনটায় দেখা হচ্ছে তাহলে।

এমন নির্ভার আহ্বানে শিক্ষার্থীদের ছায়া সুনিবিড় বৃক্ষের মতো আগলে রাখতেন। যার কথা বলার অদ্ভুত সৌন্দর্যে ক্লাসের গোমড়া ছেলেটার মুখেও মুক্তোর মতো জমকালো হাসি ঝড়ত। যার কথার কারুশিল্পে মোহিত হতে প্রতি ক্লাসের শুরুতে আমরা ব্ল্যাকবোর্ডে চকের কালিতে এঁকে রাখতাম হাবিজাবি ফুল। এসেই তিনি ডাস্টার হাতে ফুলটাকে আলত করে মুছতে মুছতে বলতেন, আশ্চর্য সব সুন্দর কথা। শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের নির্ভুল ভালোবাসার সেই ফুল মুছতে মুছতেও তিনি শেখাতেন ফুল-পুল কোন ফুলের কী বানান।

পড়াশোনায় শাসনের জন্য আমাদের এই স্যারের হাতে কখনো বেত উঠত না। তবে তাঁর কথার ধনুকে এত তীক্ষ্ণ তলোয়ার ছিল, যার দু একটা ছত্র কারও ভাগ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জুটলে সে ছাত্র প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় শূন্য সাত পেলেও নিশ্চিত, সে কথার বদহজমজনিত পীড়ায় ভুগে ফাইনালে এ না পাক, সি পেয়ে অন্তত পাস করে যাবে। যাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, শৈল্পিক কথাশিল্প আজও আমাকে বিমুগ্ধ করে বর্ণনাতীতভাবে। তিনি আমার ইংরেজির শিক্ষক কালাম স্যার।শ্রদ্ধা আমাকে কথাশিল্পের ধারণা দেওয়া আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক কালাম স্যারকে।

তখন ক্লাস টেনে আমি। শীতের কনকনে ঠান্ডায় জনজীবন কুপোকাত। ডিসেম্বর মাস। মেট্রিক পরীক্ষায় জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। আমি বোঝার আগে যিনি বুঝলেন, তিনি আমার শিক্ষক আলমগীর স্যার। সকালের পড়া স্থায়ী হয় বেশি। সেই স্থায়ীত্বের সময়কে যথাযথ ব্যবহার করতে যার ঘড়ির অ্যালার্ম আমার আগে বাজত, তিনি আমার শিক্ষক। কাকভোরে পাঁচটায় দরজার করিডরে এসে যিনি বলতেন, বাঁশি, ওঠেন আপনারা তাড়াতাড়ি, রাতের পড়াটা রিভাইজ করে নেন (স্যার, আমাদের নাম রেখেছিলেন বাঁশি)।

Post MIddle

তিনি আমার শিক্ষক। যাঁর কাছে জীবনে প্রথম আপনি সম্বোধন পেতাম শিক্ষার্থী হয়েও। যার কাছে শিখেছি ছোটদেরও সম্মানবোধ আছে। শিখেছি, সম্মান দিয়ে কথা বললে, অসম্মানেরা সে এলাকায় থাকে না। অপ্রত্যাশিত রেজাল্টে আমার আব্বু–আম্মু নয়, যিনি সবার আগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি আর কেউ নয়। আমার বিজ্ঞানের শিক্ষক আলমগীর স্যার! বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ব্যাঙ কাটার ক্লাসকে আনন্দদায়ক করতে সময়ে অসময়ে বনভোজনের আয়োজন করতেন তিনি। ক্লাস এইটে ক্লাসের ফাঁকে বলতেন, ‘আপনারা দৌড়ে গিয়ে জবা ফুল আনেন, সেই ফুল কচলে বাংলা সাবানে লাগান দেখি, কি রং হয়? ক্ষার কি? ক্ষারের চ্যাপ্টারে আসলে কি বোঝাতে চাচ্ছে? তিনি আমাদের সৃষ্টিশীল শিক্ষক আলমগীর স্যার।

শ্রদ্ধা আমাকে সম্মানবোধ শেখানো আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আলমগীর স্যারকে! অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে আমি। তখন তুই, তোরা, পাগলি, গাধি ডেকে যিনি আমাদের পড়াতেন তিনি আমার শিক্ষক। যিনি আধুনিক শিক্ষক অথচ নিজের ব্যক্তিত্বের ঐশ্বর্যে অর্জন করে নিতেন সকল সম্মান।

তিনি আমার শিক্ষক। যিনি অত্যন্ত আধুনিক স্টাইলে পড়িয়ে উশুল করে ছাড়তেন এক শ একটা হোমওয়ার্ক। শিক্ষার্থী-শিক্ষক বয়সের ব্যবধান যেখানে দুই–তিন তবুও সেখানে তাঁকে ভয় পেতাম বাঘের মতো! তিনি এতটায় ফ্রেন্ডলি ব্যক্তিত্বের ‘ব’ টাকে বিন্দুমাত্র না টলিয়ে আমাকেই বললেন ধুম করে একদিন, আমি বিয়ে করে ফেলার পরে, কিরে পাগলি, বিয়ে তো আমার আগেই করে ফেললি! কি অবস্থা…বিয়ে-শাদি ভালো? ভবিষ্যতে করা-টরার চিন্তা করতে পারি! তিনি তেমন শিক্ষক, যিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রাগৈতিহাসিক ভীতিকর চিন্তা পাল্টে দিতে পারেন একাই শতবার।তিনি আমার শিক্ষক সুজন স্যার।

শ্রদ্ধা; আমাকে বন্ধুসুলভ আচরণ শেখানো আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সুজন স্যারকে। এখনো আমি পড়ছি। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ভ্যালেন্সিয়া কলেজে। নিচ্ছি তাঁর ক্লাস, যার ক্লাসের জন্য সারাটা দিন অপেক্ষা করে থাকা যায় কলেজের করিডরে। যার ক্লাস স্ক্যাজুয়াল মিস করার চেয়ে সেমিস্টার মিস দেওয়া ভালো মনে করে সব শিক্ষার্থী! যার ক্লাসের সময়গুলো চুম্বকের মতো শেষ হয়ে যায়। তিনি আমার প্রিয় শিক্ষক মেলেইনা জেলাকাইট। রাশিয়ান এই প্রফেসর যখন কথা বলেন তখন সেসব কঠিন পড়া বলে মনেই হয় না। মনে হয় যেন বকুল ফুলের মালার মতো লেকচার সব! যিনি প্রতিটা শিক্ষার্থীর নামসহ মনোযোগের প্রকৃতি মুহূর্তেই বলে দিতে পারেন। যার কাছে শিক্ষা নিতে গিয়ে খুব শিক্ষক হতে মন চাই। যার ক্লাস করার জন্য জন্য বসে থাকি প্রতিদিন মর্নিং টু ইভিনিং! যার হেল্প ফুল মানসিকতা মননে জাগায় সকলের প্রতি সহায়ক মনোভাব দৃঢ় করার মনোরম গুণাবলি। যার টেবিল ভালোবাসা দিবসে ভরে যায় শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীদের শুভ্র শ্রদ্ধার ভালোবাসার বিবিধ ফুলে।

তিনি আমার শিক্ষক মেলেইনা জেলাকাইট। শ্রদ্ধা আমাকে ভিন্ন ভাষা আয়ত্তে আনতে সহায়তা করা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মেলেইনা জেলাকাইটকে। আজ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বলছি আমার সম্পূর্ণ শিক্ষা জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার সকল মহান শিক্ষকদের, My teacher…My master I bow to you With Folded hands…আমার বিনীত কৃতজ্ঞতা আপনাদের প্রতি। আমি মা-বাবার পরবর্তী স্থানে আপনাদের রেখেছি। রাখব জীবনভর।

জাহান রিমা ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, যুক্তরাষ্ট্র।

পছন্দের আরো পোস্ট