প্রযুক্তির নেশা ও আমাদের যাপিত জীবন । পলি শাহীনা

একটানা ৭/৮ ঘন্টা কাজ শেষে জরুরী প্রয়োজনে ম্যানহাটনের উদ্দেশ্যে বিকেল বেলা ট্রেনে উঠে বসা মাত্রই প্রচণ্ড কোলাহলের মধ্যেও ক্লান্ত শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের-ই পাই নি। ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে গন্তব্যের দিকে। হঠাৎ পাশে একটা বাচ্চার চিৎকারে ঘুম ভেংগে দেখি আমার কাপড় চোপড় অনেকখানি ভিজা এবং আমার পুরো শরীর জুড়ে চিপসের গুঁড়ো। স্ট্রলারে বেঁধে রাখা বাচ্চার মায়ের দিকে তাকাতেই উনি আমাকে সরি বলে বাচ্চাটার মুখে পেসিফায়ার গুঁজে দিয়ে আবার তাঁর ফোনে মনোনিবেশ করলেন। আমি যখন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলাম সম্ভবত বাচ্চাটার জুস, চিপসের সবটুকুই সে মনের সুখে আমার গায়ে মেখেছে, ফেলেছে বাচ্চার মা ফোনে ব্যস্ত। দুষ্ট, মিষ্টি, মেধাবী বাচ্চাটা বাকি পথ মুখের পেসিফাইয়ার খুলে আমার সাথে খেলতে খেলতে এসেছে। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম বাচ্চার মায়ের তেমন কোন মনযোগ-ই নেই তাঁর সন্তানের দিকে। উনার মনযোগের বেশীরভাগ জুড়েই ছিল হাতের মোবাইল ফোনটি। যদিও ট্রেনের পুরো ক্যামেরা জুড়েই একই দৃশ্য বিদ্যমান, প্রায় সবাই ব্যস্ত তাঁদের হাতের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসটি নিয়ে।

আমার একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
অনেকদিন আগে চোখ ঝলসানো খুব সুন্দর একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের অতিথি সারিতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করার সময় একদল তরুণ, তরুণী বর- কনের সাথে সাক্ষাৎ শেষে যাওয়ার পথে এমনভাবে আমার পায়ে আঘাত করেছিল যার ব্যাথায় বেশ কয়েকদিন ভুগেছিলাম। খুবি উদ্ধত ওই তরুণ – তরুণীর দল পিছন ফিরে সরিও বলেনি সেদিন আমাকে। হয়ত ব্যাথা পেয়েছি খেয়াল-ই করেনি তাঁরা।অসহায়ের মত তাঁদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম……….।

আজ ট্রেন থেকে নেমে বাসায় ফেরার পথে অনেকদিন আগের সে তরুণ, তরুণীগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো।সেদিন ওদের উপরে রাগ হলেও আজ মনে হচ্ছে আসলে ওদের কোন দোষ ছিল না। হয়ত তাঁদের বাবা- মায়েরাও প্রযুক্তির নেশায় মত্ত হয়ে ওদের মুখে পেসিফাইয়ার গুঁজে দিয়ে বসিয়ে রাখতো অনাদরে, অযত্নে, অবহেলায়। বড় হবার পরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পাঠিয়ে শুধু একাডেমিক শিক্ষাটাই দিয়েছে কিন্তু সামাজিক, ভদ্র, নম্র মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেনি। এখানে সবটুকু দোষ বাবা,মায়ের সন্তানদের কোন দোষ নেই…….।

আরেকটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
কোন বাসায় বেড়াতে গেলে ইদানিং বড়, ছোট প্রায় সবাইকেই প্রবলভাবে দেখা যায় যে যার হাতের ফোনটা নিয়ে ব্যস্ত। ফলস্বরুপ দেখা যায় আমরা কেউ কারো সাথে হৃদয় খুলে কথা বলিনা বলে আমাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা জন্মায় না এবং আমাদের সন্তানেরা অনেকক্ষেত্রে আত্নীয়,স্বজনের বাসা থেকে ঘুরে এসেও তাঁদের ভালো করে চেনেনা, নাম জানেনা।

Post MIddle

আমার ছোটবেলায় ইন্টারনেট ছিলনা বলে বাড়ীতে মেহমান আসলেই দেখতাম আব্বা, আম্মা মেহমানের সেবায় উনাদের নিয়োজিত করতেন। আমাকেও শিখিয়েছেন কিভাবে মেহমানের সেবা করতে হয়? কিভাবে বড়দের সম্মান করতে, কথা বলতে হয়?

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে আমাদের জীবনের অভ্যেসগুলো এখনকার দিনে বদলে গেছে। প্রযুক্তি জীবনকে যতটা বেগবান করেছে মানুষকে ঠিক ততটা যান্ত্রিক, দয়ামায়াহীন করে তুলেছে। প্রযুক্তির নেশায় পড়ে দিনদিন আমরা আপনজনদের কাছে থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছি যা সত্যিই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিপদজনক।

প্রযুক্তি ব্যাবহারের সময় আমরা বাবা,মায়েরা ও বড়দের আরো বেশী সতর্ক হতে হবে। আমাদের অতিমাত্রায় প্রযুক্তির প্রতি নেশার কারণে যেন আমাদের সন্তানেরা আমাদের থেকে তাঁদের জীবনের সহজ, সরল চাওয়া- পাওয়া, অধিকার, ভালবাসা থেকে বঞ্চিত না হয়। প্রযুক্তি যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অভিশাপ নয় আশীর্বাদ হয় সেদিকে বাবা, মা ও পরিবারের বড়দের আরো বেশী সচেতন ও যত্নশীল হতে হবে।

শুভকামনা সবার জন্য!

পছন্দের আরো পোস্ট