আট বছরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

BEROBIরংপুর একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন জনপদ। বলা হয়ে থাকে, রঙ্গ রসে ভরপুর যার নাম রংপুর।রংপুর বিভাগের একমাত্র জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয় হলো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে বহুবার। কিন্তু নানা সমীকরণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সত্তোরের দশকের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেককে কারাবাসও করতে হয়েছিলো। অবশেষে ২০০১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ফলে সম্ভাবনাময় বিশ্ববিদ্যালয়টি আর স্বপ্নের সীমা অতিক্রম করে বাস্তবতার ভূমিতে উপনিত হতে পারেনি।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আবারো আন্দোলন শুরু হলে ওই বছরই ১২ অক্টোবর ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ না করে ২০০১ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ‘রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ এর নামে অধিগ্রহণকৃত জমিতেই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর’ নামকরণ করে।এখানে উল্লেখ্য যে, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়ার আইন ছিলো। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি নিজস্ব অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হওয়ার আইনটিও বিলুপ্ত করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান। তিনি অত্যন্ত সাহস নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কোন শিক্ষক নিয়োগ ছাড়াই সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত নিয়েই ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রছাত্রী ভর্তি নেন। কিছুদিন পর ১২জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে নগরীর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি ছয় মাস ২১দিন উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মু. আব্দুল জলিল মিয়া। তাঁর দায়িত্বের চার বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে। ২০১২ সালের মধ্যে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২১টি বিভাগ চালু করা হয়। এরপর ৬ মে ২০১৩ তারিখে উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জনসংখ্যা বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এ কে এম নূর-উন-নবী।
ছয়টি বিভাগে ৩০০জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি হাটি হাটি পা পা করে যাত্রা শুরু হয়েছিলো আট বছরে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা চরাই-উৎড়াই পেরিয়ে ফুলে ফুলে সুশভিত একটি বৃক্ষে পরিণত হতে চলেছে।

জাতীয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, আধুনিক জ্ঞানচর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ, অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জনের উদ্দেশ্য সামনে রেখে এবং মান সম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে মানবতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যতে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়মিত পাঠক্রমের আধুনিকায়ন, শিক্ষার গৃনগত মান রক্ষার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যের আদান-প্রদান, দ্রুত ও ফলপ্রসু জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণের জন্য সর্বাধুনিক কলাকৌশল ব্যবহার, উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা-চেতনা এবং নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষমতা সৃষ্টি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে অর্থপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সদা তৎপর। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলেই আন্তরিক। এমনকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দে স্থানীয় রাজনীতিক, সাংবাদিক, সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণই একেকজন অতন্দ্র প্রহরী।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক সংকটসহ শিক্ষার যাবতীয় উপকরণ সংকট নিরসনে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ২১ টি বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট হাজার। অবশ্য ইতিমধ্যে দু’একটি ব্যাচের শিক্ষার্থী ব্যাচেলর ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। সর্বশেষ বিসিএস পরীক্ষায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। সমাজের অবহেলিত একটি অংশ তৃতীয় লিঙ্গদের (হিজরা) সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির জন্য বাংলাদশে প্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে হিজরা কোটা চালু করা হয়েছে। চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের জন্যও বিশেষ কোটা প্রবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিসহ অন্যান্য প্রচলিত কোটা চালু অব্যহত রয়েছে।

নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে যুগোপযুগী হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের আন্তরিকতা প্রশংসার দাবিদার। প্রশাসনিক কর্মকা- সম্পাদনের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন দক্ষ কর্মকর্তা ও অনুগত কর্মচারী।

Post MIddle

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি সহশিক্ষামূলক কর্মকা- পরিচালিত হয়। বিভিন্ন দিবস ও বিষয়ে আলোচনা, সভা, সেমিনার, কর্মশালাসহ আয়োজন করা হয় বিতর্ক, খেলা-ধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার। এছাড়াও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সুস্থ্যধারার কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন সাহিত্য ও ম্যাগাজিন পত্রিকা বের করে থাকে। সকল ধর্মের ধর্মীয় কর্মকা- অনুষ্ঠিত হয় সকলের উৎসবমুখর পরিবেশে।

শিক্ষা ও গবেষণার জন্য সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার নামানুসারে ‘ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালু করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানটি আরো কর্মমূখী ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে এর নাম ‘ড. ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট’ রাখার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাইবার সেন্টার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-ই-লার্নিং সেন্টারসহ প্রযুক্তি নির্ভর কয়েকটি ল্যাবর্রেটরি স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা-গবেষণা ও শিক্ষার মান উন্নয়নে কয়েকটি প্রকল্প চলছে।

ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুইটি বাস উপহার দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরো দুইটি বাস কিনেছেন। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের জন্যও রয়েছে পৃথক বাস। কর্মচারীদের জন্যও সম্প্রতি একটি বাস কেনা হয়েছে। জরুরী রুগী বহনে সার্বক্ষনিকভাবে রয়েছে একটি এম্বুলেন্স।

নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন সুবিধা উল্লেখ করার মতোই। ছাত্রদের জন্য চালু করা হয়েছে দুইটি আবাসিক হল। যার একটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল’ এবং অপরটির নাম ‘শহীদ মুখতার ইলাহী হল’। ছাত্রীদের জন্য চালু হওয়া হলটির নাম ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’। ছাত্রীদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট এক হাজার আসনের অপর হলটি নির্মাণ কাজ শুরু হবে। একই সাথে ১০ তলা বিশিষ্ট ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ভবনের নির্মাণ কাজও শুরু হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য দু’টি ডরমিটরি চালু হয়েছে। আরো দু’টি ডরমিটরি চালু হওয়ার অপেক্ষায়।

নতুন এই ক্যাম্পাসের সবুজায়ন যে কোন আগন্তকের মন কাড়বে। খুব কম জাতের গাছ আছে যা এই ক্যাম্পাসে নেই। যত দুর্লভ গাছই হোক না কেন এই ক্যাম্পাসে পাওয়া যেতে পারে। তিন মাস থেকে শুরু করে ৫ বছর বছরের নানা বয়সী প্রায় ৩০ হাজার তরুণ গাছ আগন্তককে স্বাগত জানায়। বৃক্ষ প্রেমীদের জন্য এই ক্যাম্পাস ইতিমধ্যে অনেক আকর্ষনীয় হয়ে উঠেছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামোর নির্মাণ কাজকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। এরমধ্যে প্রথম ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের কম্পোনেন্টগুুলো নির্মাণের জন্য দ্বিতীয় প্রকল্প প্রস্তুত করা হচ্ছে। সরকারের সদয় বিবেচনা হলে অতিদ্রুতই মনোমুগ্ধকর ও নান্দনিক একটি ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে উঠবে এটি। শুধু ভৌত অবকাঠামোর নান্দনিকতায় নয় শিক্ষা বিস্তারেও এই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে বিশ্বের সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতোই অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। প্রতিষ্ঠার আট বছরে এটিই প্রত্যাশা।

লেখক: মোহাম্মদ আলী।ইনফরমেশন অফিসার।বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
ই-মেইল: mdaliiu@gmail.com

পছন্দের আরো পোস্ট