পিছনের বেঞ্চিতে চুপটি করে বসে থাকতাম। রিমি রুম্মান
খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুল শেষ করে যখন মাতৃপীঠ গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হলাম, সেখানেও ছিল ভয়াবহ আতংক। রওশন ম্যাডাম পড়া না পারলে বেত নিয়ে সামনে আসতেন। কখনো ডান হাত, কখনো বাঁ হাত মেলে ধরতে হতো। হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত ভয়াবহ ভাবে।বুকের ভেতরটায় যেন কেউ খামচি দিয়ে ধরেছে। চোখ মুখ খিঁচে থাকতাম। অতঃপর ম্যাডাম তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ঠাস্ঠাস্ মারতেন। ক’দিন সেই হাত ফুলে থাকতো, ব্যথায় গোঙাতাম সকলের অগোচরে। কখনো বা বারান্দায় রোদে দাঁড় করিয়ে রাখতেন একপায়ে। পা যদি এক পলকের জন্যেও মেঝেতে লাগতো, অমনি উঠে এসে ঠাস্ঠাস্।যেহেতু পড়া পারিনি বলে মার খাওয়া, তাই বাড়িতেও কাউকে বলা যেতো না এ অমানবিক নির্যাতনের কথা।
সব শিশুর তো আর একই সমান মেধা কিংবা পড়া বুঝবার ক্ষমতা থাকে না। আমি সেই কম বুঝা কিংবা দেরিতে বুঝা টাইপের ছাত্রী ছিলাম। তাই স্কুল জীবন আমার কাছে দুঃসহ যন্ত্রণাময় একটি জীবন ছিল। খুব দুঃখ কষ্ট নিয়ে আজ শিক্ষক দিবসে বলতেই হচ্ছে ক্লাসের অন্যতম খারাপ ছাত্রীটির পাশে পরম মমতায়, নির্ভরতায় কোন শিক্ষক এগিয়ে আসেনি।কোনদিন কোন শিক্ষক জানতে চায়নি কেন পড়া পারছিনা, কিংবা কি সমস্যা। সেদিনের শিশু আমি আজ দুই সন্তানের মা।
এখানে নিউইয়র্কের স্কুলগুলোয় প্যারেন্ট-টিচার কনফারেন্স হয় বছরে তিনবার। প্রতিবার রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে ছেলের শিক্ষকদের সাথে সেইসব মিটিং এ আমি তাঁর হাতের লেখা নিয়ে আলোচনা করি।সপ্তম ক্লাসে পড়া বড় ছেলে রিয়াসাত, যার হাতের লেখা এত ছোট, যা পড়া এবং বুঝা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।খানিক বিরক্তি, উদ্বেগ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করি কেমন করে সে রাইটিং এ ৯৮% নাম্বার পায় ! কিন্তু শিক্ষকরা প্রতিবারই আমায় আশ্বস্ত করে এই বলে যে”এখন টাইপিং এর যুগ, হাতের লেখা নিয়ে এত চিন্তিত হবার কোন কারন নেই, তাছাড়া আমাদের বুঝতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। তুমি যদি এটি নিয়ে তাঁকে মানসিক চাপে রাখো, তাহলে সে মূল বিষয়টি লিখতে ভুল করবে কিংবা অমনোযোগী হবে।”
বছরের দুই মাস যখন স্কুলগুলোয় গ্রীষ্মের ছুটি থাকে, সেই সময়টাতে প্রতিটি পরিবার নিজেদের সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় করে যার যার মতকরে বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দে মেতে উঠে। কেউ শহরের ভেতরেই আনন্দ বিনোদনে সময় কাটায়। কেউবা দূরের শহরে। এই যে এত হৈ হুল্লোড়, লেখাপড়া বিহীন ঘুরে বেড়ানো, এর মাঝেও আমার ছয় বছরের ছোট্ট রিহান মাঝে মাঝেই উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে যায় অবিরত”আমি স্কুলে যাবো না ? কখন আবার স্কুলে যাবো ? আমি আমার স্কুল মিস করি, টিচার মিস করি… ” এমন প্রশ্নে আমি আমার পিছনে ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবি।
আমার এমন একটি শৈশব প্রয়োজন ছিল, এমন কিছু স্মৃতি বড় বেশি প্রয়োজন ছিল, যেখানে আজ গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম ” আমি আমার স্কুল মিস করি, আমি আমার শিক্ষকদের মিস করি।”
শিক্ষকদের ছায়ায় পরম মমতায়, নির্ভরতায় ভাল থাকুক আমাদের শিশুরা।
রিমি রুম্মান নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র