হাড় থাকলে মাংস একদিন হবে
সূর্যের স্বভাবত সে সকালে ওঠে। অনেক সময় মেঘ কিংবা অন্য আবহাওয়া জনিত কারণে বাঁধাগ্রস্থ হলেও হয়ত স্বল্প বা দীর্ঘ সময় দেখা না গেলেও একটা সময় তাকে দেখা যায়। মানুষের বাস্তবিক শিক্ষা তেমনি সূর্যের ন্যায়। সকালের সময় সাতটা হওয়ার আগেই বাসায় হুজুর এসে হাজির। দুই ঘন্টা আরবী পড়ানোর কথা থাকলেও সে বেশীরভাগ দিন এক থেকে দেড় ঘন্টাই পড়ায়। রাজন আরবীটা বেশ ভালোই পারে। তাই হুজুরও তেমন মারে না। যদিও প্রথমে একদিন মারতে উদ্যত হয়েছিল । তখন রাজন বুদ্ধি করে বলল-হুজুর , আপনি জানেন না। শিশুদের মারতে নেই সরকার নিষেধ করে দিয়েছে। যে মারবে তার নামে কেস করে দিলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। বাবা বলেছে- হুজুররা বেশীর ভাগ সাহসী হয়ে থাকে। এই যে বর্তমানে জঙ্গীরা খুব সাহসী এবং অনেক খারাপ শুধু মানুষ মারে। কিন্তু রাজনের হুজুরের তো তেমন সাহস নেই। পুলিশের নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেছে। হুজুরের পড়া শেষ করেই তাকে যেতে হয় বাসা থেকে প্রায় আধঘন্টার পথ দূরে একটি প্রাইভেট ব্যাচে। নার্সারী স্কুল থেকে গত বছর তার মা তাকে এই ব্যাচে ভর্তি করিয়েছে। তার মায়ের ধারণা এই ব্যাচে টাকা বেশী নেয় তাই পড়ায় বেশী বেশী। যদিও তার মা ক্লাস নাইনের বেশী পড়তে পারে নি।
রাজন তার নানুর কাছ থেকে শুনেছে -তার মায়ের নাকি পড়তে ইচ্ছে করত না তবে খুব ভালো ছবি আঁকতে পারত। আর নানার ছবি আঁকা পছন্দ না তাই তাড়াহুড়ো করে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সৌদি আরবে চলেগেছে। ব্যাচের ক্লাস শেষ হতে প্রায় দুইটা বেজে যায়। দুপুরের খাবার, গোসল শেষ করে একটু কার্টুন দেখবে বলে বসেছে তখনই স্যার এসে হাজির। রাজনের খুব রাগ হয় মনে হয় স্যারকে ঘাড় ধরে বাসা থেকে বের দেই। এমন সময় কেউ আসে। মন চাইলেও কিছু করার থাকে না কেননা অবাধ্য হলে মা খুব মারে। মায়ের প্রচন্ড রাগ। হঠাৎ হঠাৎ করে রেগে যায়। তার রাগের কোন সময়জ্ঞান নেই। বাধ্য ছেলের মত মারের ভয়ে স্যারের কাছে পড়তে বসে। স্যারটা রাজনকে খুব ভালো বাসে। মাঝে মাঝে মজার মজার কবিতা লিখে দেয়। গল্প শোনায়। স্যার বাংলা ,ইংরেজি ,সমাজ,বিজ্ঞান এসব পড়ায়। শুধু অংকটা আরেক স্যার পড়ায় সে আসে সন্ধ্যা সাতটায়। ওই স্যার খুব রাগী। অংক ভুল করলেই স্কেল দিয়ে পেটায় তাও আবার স্টিলের স্কেল। মারলে খুব ব্যাথা লাগে শরীরে দাগ কেটে যায়। তবুও মা বলেছে- আমার ছেলে অংকে অনেক কাঁচা । ওকে ভালো করার দায়িত্ব আপনার । খেয়ে খেয়ে মোটা হয়ে যাচ্ছে আমি শুধু ওর হাড়গুলো চাই মাংস লাগবে না। হাড় থাকলে মাংস একদিন হবে। রাজনের বাবা একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিব মা বাসায় হাস-মুরগীর খামার করেছে। বাবা সকাল আটটায় বাসা থেকে বের হয় আর রাত দশটা পরে ছাড়া আগে কোনদিন ফেরে না। তবে বাবা তাকে খুব আদর করে। যা চায় তাই এনে দেয় শুধু দেয় না সময়। মা সময় দেয় তবে সাথে বকুনি আর কানমলা, থাপ্পর সাথে ফ্রি থাকে। তাছাড়া সেও সারাদিন খাবার রান্না আর এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে।
রাজন এই বছর ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টুতে উঠেছে। সামনে তার ক্লাস থ্রিতে ভর্তি পরীক্ষা। সে সন্তান হিসেবে খুব মেধাবী কিন্তু ছাত্র হিসেবে নয়। কেননা তার কথাবার্তা, ব্যবহার, অনেক মার্জিত। এই বয়সেই সে খুব ভেবে কথা বলে। সময় পেলে মাকে কাজে সাহায্য করে। তার একটা নেশা আছে তা হল অনুসন্ধান আর ভাঙ্গা জিনিস জোড়া লাগানো। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ গুলো সারাই করা। এই যেমন তার বাবা খেলনার গাড়ী, হেলিকপ্টার এনে দিবে সে সেগুলো খুলবে আর মা বকা দিবে আবার আগের মতই লাগাবে। মাঝে মাঝে তার বাবা তার বিষয়ে নিয়ে খুব প্রশংসা করে। সে একবার তার মায়ের হাত ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেলে সেটি ঠিক করে দিয়েছিল সেবার মা খুব খুশী হয়েছিল। ব্যাচের ত্রিমাসিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আবারও অংকে খারাপ করেছে। ব্যাচের স্যাররা বকাবকি করেছে। রাজনের বন্ধু শিহাব অংকে ভালোই করেছে। তাই রাজনের মা আরও খেপে গেছে। অবস্থা বেগতিক যেন ওখানে বসে মারলেই সে খুশী। রিক্সায় মা-ছেলের মাঝে কোন কথা হয় নি। রাজন ভয়ে ভয়ে থরথর কওে কাঁপছে। বাসায় গেলে না যেন আজ অবস্থা কেমন হয়। বাসায় পৌছে তার মা কিছুই বলে নি। তবে তার সাথে কোন কথা বলছে না। তার মা রেগে গেলে চেহেরা লাল বর্ন হয়ে যায় আর শুধু ঘেমে যায়। আজ তেমনই অবস্থা। ইংরেজি স্যারকে ফোন করে আজ আসতে নিষেধ করে দিয়েছে। অংক স্যারকে একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলছে। সন্ধ্যার পরপরই অংক স্যার এসে উপস্থিত। অংক স্যার চেয়ারে বসতেই মা রেজাল্ট শিটটা টেবিলের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে সারাদিনের রাগ ঝারল স্যারের উপর। ব্যাস! স্যারও তার রাগ ঝারল রাজনের উপর। বেদম পেটানোতে স্কেলটা বেঁকে গেছে আর রাজনও একটু কান্নাকাটি না করে একদম শক্তচুপ হয়ে মার খেল। রাজনের একটা অভ্যাস হল তাকে বকুনি দিলে সে কেঁদে দেয় কিন্তু মারলে সে কাঁদে না। এই অভ্যাসটা নাকি তার মায়েরও ছিল। পরেরদিন রাজনের শরীরে জ্বর একশ পাঁচ এর বেশী। কোন ওষুধে কাজ হচ্ছে না । তাই রাজনের বাবা তার পরিচিত এক শিশু বিশেষজ্ঞ বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। গতকাল থেকে রাজন কারো সাথে কথা বলছে না। ডাক্তার বলেছে- শিশুর শরীরের অবস্থা ভালো না জ্বর খুব বেশী, মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরন হয়েছে। অনেকটা মানসিক ভাবেও অসুস্থ। অন্তত চার মাস বেডরেস্ট প্রয়োজন তার বেশীও লাগতে পারে। আপাতত কিছুদিন ক্লিনিকে থাকতে হবে। তিনদিন পর তার বাবা বারবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু রাজন কোন কথা বলে না। সে চোখ বন্ধ করে রাখে। রাজনের বাবা ডাক্তারকে ব্যাপারটা বলল। ডাক্তার বলল- দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই আপনারা কেবিনে গিয়ে বসুন । আমি ব্যাপারটা দেখছি। রাজন জানালার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। তার পায়ের কাছে মা আর মাথার কাছে বাবা বসা। কেবিনে ডাক্তার প্রবেশ করল হাতে একটা ভিডিও গেমস। ডাক্তার বলল-রাজন , বাবা তুমি কেমন আছো? রাজন কোন উত্তর দিল না। ডাক্তার বলল- আচ্ছা, রাজন তোমার বাসায় কি কোন ভিডিও গেমস আছে। তোমার কোন গেমস খেলতে ভালো লাগে? রাজন হঠাৎ করে এক রকম লাফ দিয়ে উঠে বলল।
-হ্যা, আংকেল আছে তো। আমার এ্যাংরি বার্ড খেলতে খুব ভালো লাগে।
-এই নাও তোমার ভিডিও গেমস। এটা তোমার জন্য আমার গিফট। রাজন গেমসটি হাতে নিয়ে বলল-আংকেল থ্যাংক ইউ। আপনি অনেক ভালো । জানেন, আমারও না বাসায় এমন একটা ভিডিও গেমস আছে।
-ওয়েলকাম, বাবা। আচ্ছা, রাজন তোমার বাসায় আর কি কি আছে?
-অনেক কিছু। এই ধরেন ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ভিডিও গেমস, ক্রামবোট, লুডু, ক্রিকেটের ব্যাট, বল আরও কত কিছু।
-তুমি কখন ক্রিকেট খেলো?
-ভিডিও গেমস খেলারই সময় পাই না আরতো ক্রিকেট খেলব। জানেন , আংকেল আমাদের পাড়ায় না একটা বড় মাঠ আছে। আগে আমি মাঝে মাঝে যেতাম এখন আর যাই না। আ¤মু যেতে দেয় না।
– কেন যেতে দেয় না?
– অনেক গুলো হোমওয়ার্ক করা লাগে ঠিকমত না হলে ব্যাচের টিচাররা অনেক বকাবকি করে তো তাই।
-আচ্ছা, তুমি কোন কার্টুন দেখতে খুব পছন্দ কর?
-ডোরেমোন আর বাটুল দ্য গ্রেট। জানেন, আংকেল কতদিন যে আমি বাটুল দ্য গ্রেট দেখি না।
-কেন দেখো না?
-কিভাবে দেখব! ডোরেমনই ঠিকমত দেখতে পারি না আরতো বাটুল দ্য গ্রেট। যখনই ডোরেমন শুরু হয় তখন বাংলা টিচার চলে আসে আর অন্য সময়ে হোমওয়ার্ক করা লাগে। রিমোট ধরলেই আম্মুর বকুনি। এখন আমি সিরিয়াল দেখব যাহ! পড়তে বস। কালকে ব্যাচ আছে।
– আচ্ছা, তোমার নানু বাড়িতে যাওনা কতদিন?
-আব্বু বলছে’ আমার জন্মের পর নাকি একবার গেছিলাম। কিন্তু কবে তা আমার মনে নেই।’
-তোমার নানু,দাদু কে দেখতে ইচ্ছে করে না?
-আংকেল আপনি কি পাগল নাকি। নানু, দাদু কে দেখতে ইচ্ছে করে না পৃথিবীতে এমন কেউ আছে নাকি। দেখতে ইচ্ছে করলে আম্মু কল করে তাদের কে নিয়ে আসে।
“হ্যা, বাবা আমি একটু পাগল হয়ে যাই মাঝে মধ্যে তোমাদের মত যখন কেউকে পাই।”- ডাক্তার মিস্টি হেসে বলল।
-নাহ! আংকেল আপনি অনেক ভালো। আপনার গলার এই বড় হেডফোনটা আমায় একটু দিবেন।
-হ্যা, দিব নাও। তবে এটা কিন্তু হেডফোন না এটা ডাক্তারি যন্ত্র।
-না, আংকেল আমি তাহলে নিব না। আমার ডাক্তার ভালো লাগে না। আমি হব ইঞ্জিনিয়ার। জানেন, আম্মু না আমাকে জোর করে ডাক্তার বানাতে চায়।
-আচ্ছা, বাবা তুমি ইঞ্জিনিয়ারই হবে। নাও এবার গেমস খেলো আর রেস্ট নাও।
এতক্ষন মা-বাবা শুধু তাদের দুজনার কথা শুনছিলেন। তাদের দু’জনার চোখ থেকে অবিরাম অশ্রু ঝরছে। কেউ কোন কথা বলছে না বোঝা গেল তারা তাদের ভুল বুঝতে পারছে। তবে ডাক্তার কেবিন থেকে প্রস্থান করার সময় একটা কথা বলেছেন। তিনি বললেন-আমি যদিও বাংলা বিভাগের ছাত্র নই তবুও বাংলা আমার মাতৃভাষা তাই রবীন্দ্রনাথ আমার প্রিয় কবি। তার একটা কথা আজ খুব মনে পড়ছে। কথাটা হল। শিশুকাল হইতেই , কেবল স্মরণশক্তির উপর সমস্ত ভর না দিয়া, সঙ্গে সঙ্গে পরিমানমত চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তির স্বাধীন পরিচালনার অবসর দিতে হইবে। সকাল হইতে সন্ধ্যা কেবলই লাঙ্গল দিয়া চাষ এবং মই দিয়া ঢেলা ভাঙ্গা, কেবলই ঠেঙালাঠি মুখস্থ এবং এক জমিন আমাদের এই’মানব-জনম’ আবাদের পক্ষে , আমাদের এই দুর্লভ ক্ষেত্রে সোনা ফলাইবার পক্ষে যথেষ্ট নহে। এই শুষ্ক ধুলির সঙ্গে , এই অবিশ্রাম কর্ষণ পীড়নের সঙ্গে রস থাকা চাই।#
আরএইচ