জাবির লাইব্রেরিতে চলছে জীবন গড়ার প্রস্তুতি

এক সময় লাইব্রেরি মানেই ছিল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম। জ্ঞানের একমাত্র উৎস স্থান। অনলাইন দুনিয়ায় কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে লাইব্রেরিতে। এসেছে নতুন মাত্রা। লাইব্রেরিতে যুক্ত হয়েছে ওয়াইফাই। শুধু লাইব্রেরির নির্দিষ্ট বই পুস্তুকে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশ-বিদেশের অনলাইন লাইব্রেরির সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। নীরব আড্ডারও স্থান হয়ে উঠেছে লাইব্রেরি। বলছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির কথা।

Post MIddle

৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাহিদ। পড়াশোনা পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে। স্নাতকোত্তর যখন প্রায় শেষের পথে তখন উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশে পাড়ি জমানোর ইচ্ছা চেপে বসল। সিদ্ধান্ত নিল জিআরই পরীক্ষা দেওয়ার। রুমে পড়াশোনা করতে চাইলেও বাকি তিন রুমমেটের সিরিজ গল্পে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মনে হলো ক্যাম্পাস জীবনে খুব বেশি তো লাইব্রেরিতে যাওয়া হয়নি, তাহলে ঘাটতিটা পুষিয়ে দেই। লাইব্রেরিতে গিয়ে নাহিদ দেখল, সেখানে শুধু ও একা নয়, জিআরই দিতে আগ্রহী এমন অনেকেই একত্রে পড়ালেখা করছে। তাদের সঙ্গে যোগ হলো স্বপ্নপূরণের নতুন জীবন। জিআরই পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত লাইব্রেরিতেই পড়ালেখা করেছে নাহিদ। প্রত্যাশিত স্কোরটাও পেয়ে গেছে। বাকি আছে উড়াল দেওয়ার। নাহিদের মতো মামুন, আল-আমিন, প্লাবন এরাও লাইব্রেরিতে নিয়মিত জিআরইর পড়াশোনা করে।

সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৩৯তম শিক্ষার্থী নাজমুল। ক্যাম্পাসের শুরুটা হয়েছিল ছাত্ররাজনীতিতে নাম লিখিয়ে। সময়ের ব্যবধানে যখন বুঝতে পারল ক্যাম্পাস শেষে চাকরিটা ভালো না পেলে মুক্তি নেই। সে সময় থেকে তার লাইফস্টাইলে আসে পরিবর্তন। কাকডাকা ভোরে চোখ মুখে কোনো রকম পানি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে। খাওয়া আর গোসল করতে রুমে আসে। বাকি সময়টা লাইব্রেরিতেই কেটে যায়। নাজমুল ৩৫তম বিসিএস-এ শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছে। লাইব্রেরিতে বিসিএসএরও গ্রুপ আছে। আছে আইইএলটিএস, ব্যাংক জবের আলাদা আলাদা গ্রুপ। গ্রুপ থেকে আয়োজন করা হয় পরীক্ষার। দেওয়া হয় দৈনন্দিন পাঠ্যক্রম।

সবাই লাইব্রেরিতে গিয়ে যে শুধু লেখাপড়াই করে তা নয়। চুপিচুপি প্রেমেরও ভালো জায়গা লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে পড়তে গিয়েও কারও আবার মনের দেওয়া-নেওয়া হয়।
সকাল ৮টায় লাইব্রেরি খোলা থাকলেও আগে না গেলে জায়গা পাওয়া যায় না। তাই আগে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। অথবা ব্যাগ বা বই রেখে লাইনে নিজের সিরিয়াল রাখতে হয়। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনে লাইব্রেরির আসন সংখ্যা কম থাকায় সিট দখলে নিতে কখনও বা শিক্ষার্থীদের শারীরিক যুদ্ধেও নামতে হয়। অপ্রীতিকর ঘটনাও কখনও কখনও ঘটে।

লাইব্রেরিতে ওয়াইফাই সংযোজন ছাড়া তেমন আপডেট করা হয়নি। নিজস্ব কোনো ওয়েবসাইটও নেই। লাইব্রেরি সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হন শিক্ষার্থীরা। ভুগোল ও পরিবেশ বিভাগ ৪২তম আবর্তনের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম তো ফেইসবুকে লিখেই ফেললেন ‘অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, জাবি লাইব্রেরিতে সিট পাওয়া যেন মহাভাগ্যের ব্যাপার। সম্প্রতি আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।’

১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ লাইব্রেরির আড়াই যুগ কেটে গেলেও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। আসন সমস্যা, ফ্যানের অভাব, পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব। লাইব্রেরির অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বইয়ের সংকট। যদিও কাগজে-কলমে বই, জার্নাল ও রেফারেন্স বই রয়েছে দেড় লাখের কাছাকাছি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ লাইব্রেরিতে অনেক বই-ই পাওয়া যায় না। যেসব বই পাওয়া যায়, তারও আবার গুরুত্বপূর্ণ পাতা বা ছবিগুলো থাকে কাটা-ছেঁড়া। এ ব্যাপারে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিনা নাজিয়া জানান, ‘লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় বই খুবই কম। বিশেষ করে দামি বই একবারেই পাওয়া যায় না। বইগুলো খুব প্রয়োজনীয় হলেও তা শিক্ষার্থীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তাই লাইব্রেরিতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় থাকে না।’ অবস্থা যাই হোক সকাল আটটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবগুলো আসন পূর্ণ হয়ে যায়। লাইব্রেরিতে তখন পিনপতন নীরবতা। কেউ একা কেউবা গ্রুপ স্টাডি করেন।

এছাড়া লাইব্রেরিতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইফাই ব্যবহার করে জে-স্টোরসহ (ww w.jstor.org) কয়েকটি অনলাইন লাইব্রেরি থেকে প্রয়োজনীয় বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন শিক্ষার্থীরা। ইদানিং লাইব্রেরিতে ফ্রিল্যান্সে আয় করতেও ভীড় জমান কেউ কেউ।

লাইব্রেরিতে স্নাতক শেষ করা শিক্ষার্থীদের ভীড় থাকে বেশি। যার কারণে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা আসন পান না। ইতিহাস বিভাগের ৪৩তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল নোমানের আক্ষেপ, ‘লাইব্রেরিতে সাবেক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি থাকায় আমরা যারা নিয়মিত শিক্ষার্থী তারা আসন পাই না।

জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সিনিয়র বুকসটার শিমুল কুমার বড়ুয়া বলেন ‘আমার ২২ বছরের চাকরি জীবনে দেখা এখনকার মতো এতো বেশি ছাত্রছাত্রী লাইব্রেরিতে কখনও আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকের চেয়ে এখন ছাত্রছাত্রী অনেক বেশি পরিমাণে লাইব্রেরিতে আসে পড়াশোনার জন্যে। তবে লাইব্রেরিতে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগের মনোযোগ চাকরির পড়াশোনার দিকে।

শিক্ষার্থীদের নিবিড় জ্ঞানার্জনের জন্য লাইব্রেরিমুখী হওয়ার বিকল্প নেই। প্রশাসনের উচিত লাইব্রেরির আসন বাড়ানোর পাশাপাশি আধুনিক লাইব্রেরির সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। এমনটি প্রত্যাশা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ জিহানের।#

আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট