তরুণরা কেন বিপথগামী হচ্ছে । মো. বশিরুল ইসলাম

আাগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম-বাউল শাহ আবদুল করিমে এ গানটি সবাই জানা। আসলেই তাই, আগের দিনগুলোই ভাল ছিল। আজ যখন দেখি তরুন বয়সে একটা ছেলে ধর্মান্ধ হয়ে খুন করছে। খুন করা পর খুনিরা লাশগুলো উপর খুপিয়ে বীভৎস প্রতিশোধ নিচ্ছে- এসব কি কোনো ভাবে মেনে নেওয়া যায়? আর এসব কর্মকান্ডে উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা জড়িয়ে পড়ে-তাহলে? আমাদের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে-মাদ্রাসার ছাত্ররাই বুঝি শুধু জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত হয়। কিন্তু এখন আমরা দেখছি উল্টো চিত্র। সমাজের উঁচু স্তরের পরিবারের সন্তান বা নামী-দামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যেই এ ধরনের উগ্র মতবাদের প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। তাদের ধর্মের অপব্যাখ্যা মাধ্যমে মগজ ধোলাই করে সন্ত্রাসী, জঙ্গি বানানো হচ্ছে। ধর্ম সম্পর্কে ভালোভাবে না বোঝার কারণেই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া পিতা-মাতা সন্তানদের ব্যাপারে উদাসীন থাকা এসব সন্তানরা সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সারা বিশ্বের কাছে যে বাংলাদেশ গর্বভরে বলত, আমাদের তরুণেরাই সেরা। এরাই ৭১ এ দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, এই তরুণরাই একুশ শতকের ইমার্জিং বাংলাদেশের প্রতিনিধি, তারাই কি না এমন ঘটনা ঘটাল!

গুলশান থেকে শোলাকিয়া, শোলাকিয়া থেকে কল্যাণপুরে জঙ্গি হামলা-নাশকতার ঘটনা এ দেশকে একটি নতুন মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। সবার মনে এক ধরনের আত্মষ্ক কাজ করছে। যে কোনো সময় এর চেয়ে বড় কোনো নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা তো দেখলাম-গুলশানের ঘটনা পর সরকার এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে চলে যাবার পরও কল্যাণপুরে ঘটনা ঘটল। যতটুকু জানা যার-কল্যানপুরে জঙ্গিরা পাকিস্থানের আদলে একটি কেজি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে জিম্মির পর হত্যার পরিকল্পনা ছিল। আসলে জঙ্গীদের শেকড় এত গভীরে বিস্তৃত যে এর মূলোৎপাটন সহজ ব্যাপার নয়।

তাহলে কিভাবে এ জঙ্গিদের রুখে দেয়া যায়- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা খুবই জরুরী। এজন্য সবাইকে আরো সক্রিয় হতে হবে। একই সঙ্গে এসব তরুণদের সাধারণ মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া নৈতিক শিক্ষারও বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কীভাবে আরো মানবিক করা যায় সে বিষয়গুলো পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য খেলাধুলার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা দরকার। সে সাথে তরুণদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখতে হবে। আর ইন্টারনেটের ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে হবে বিপথগামী থেকে রক্ষা করতে হবে।

এবার ফিরে যায়-আমার গানের কথা। অর্থাৎ শৈশবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মা আমাদেরকে পাঠাতেন মক্তবে। তারপর এসে নাস্তা করে পড়াশোনা শেষ করে স্কুলে যেতাম। স্কুলের টিফিন বা ছুটির ঘণ্টা বাজতেই মাঠে নেমেই হইহুল। খেলতাম হাডুডু, লুকোচুরি, কানামাছি, চোর পুলিশ, মাববেল খেলা, গোল্লাছুট । আর হাতে বানানো কাগজের উড়োজাহাজের দুনিয়া দেখার দিন গুলো এখন শুধুই ইতিহাস। আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে বাবা-মা ছেলেকে ঘুম থেকে উঠে পাঠিয়ে দিচ্ছে নামি-দামি স্কুলে। ক্লাশে বসেই টিফিন। স্কুল থেকে ফিরলে চলে আসছে গৃহ শিক্ষক। এভাবে চলছে তাদের জীবন। যেনো খাঁচায় বন্দি পোষা পাখি । খেলার জায়গা বলতে এক চিলতে বারান্দা। নগরীতে শিশুর খেলা মাঠ এখন ট্যাব,মোবাইল কিংবা কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটর। পাড়া-মহাল্লায় না স্কুলে কোথাও আমাদের সন্তানদের জন্য খেলার মাঠ নেই। অলিতে গলিতে স্কুলের ঠাসাঠাসি। দূরন্ত শৈশবটাই যেনো হারিয়ে যাচ্ছে তাদের। নগরায়ন আর আধুনিকতার অজুহাতে বিলীন হয়েছে খেলার মাঠ। আর তাই মোবাইল ফোন আর কম্পিউটারের ছোট্ট মনিটরেই খেলার দিকে ঝুঁকছে শিশু-কিশোররা। এতে শরীরে ও মনে চরম দুর্বল আর আত্নবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ছে আমাদের প্রজন্ম। স্কুল যেমন পড়া লেখার জায়গা তেমনি তা খেলারও জায়গা। খেলাধূলা আর সহপাঠীদের সাথে সঠিকভাবে মেলামেশার অভাবে এসব শিশুরা ঘরকুনো  হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে এ শিশুরা যখন পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়-তখন নতুন জায়গা-নতুন পরিবেশ-নতুন বন্ধু পেয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। এমনই একটা বিজ্ঞাপন সাম্প্রতিক টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার হচ্ছে।

গুলশানের হলি আর্টিজান, শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান, কণ্যাণপুরের হামলাকারী জঙ্গিদের মধ্যে যারা মারা গেছে, তাদের কেউ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কেউ বিত্তবান ঘরের সন্তান, কেউ উচ্চ শিক্ষিত, কেউ স্বল্পশিক্ষিত আবার কেউ মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্র। কিন্তু তাদের মধ্যে অদ্ভুত মিল হলো-সবাই ঘরপালানো। কেউ এক-দুই বছর আগে থেকে আবার কেউ কয়েক মাস হলো নিখোঁজ। এখন ভাবা সময় হয়েছে-তরুন প্রজন্ম অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী কেন জঙ্গী হবে? এ জঙ্গিরা কত দূর যেতে পারে? তাদের মদদাতা কে? অর্থের উৎস কী? কোন মোহ থেকে এ পথ বেঁচে নিচ্ছে? নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও পিতা-মাতার স্বপ্ন চুরমার করে দিয়ে তারা কেনইবা বেছে নিল এই অন্ধকার পথ? নিশ্চিত অপমৃত্যুই এই ভ্রষ্ট মতবাদের একমাত্র শেষ ঠিকানা। কিন্তু তারপরও কেন তারা বিপথগামী হয়ে এ পথে পা বাড়াল? এর কারণ কি শুধুই আদর্শিক, না রাজনৈতিক কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো মহল বিশেষের ঘৃণিত স্বার্থের ফাঁদে পা দিয়েছে এরা। আর যারা এভাবে আত্মঘাতী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছে এদের ফেরানোর উপায় বা কী।

Post MIddle

সম্প্রতি এসব ঘটনার মোটামুটি একটা ছক যদি দাঁড় করানো যায় তাহলে আমরা দেখি-বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্য, সঠিক শিক্ষার অভাব, শিক্ষিত তরুণদের প্রত্যাশিত কর্মসংস্থানের অভাবই তরুণ ও কিশোরদের জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত করছে । তবে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে ইন্টারনেটের। ফেসবুক থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে ধর্মের অপব্যাখ্যা চলছে। কিশোর-তরুণ হচ্ছে এর প্রধান শিকার। তা ছাড়া বাবা-মা তাদের সন্তানদের দিকে সেভাবে নজর দিতে পারছেন না নানা ব্যস্ততার কারণে। পিতা তার বন্ধু-বান্ধব,ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অন্যদিকে মা তার নিজের জগতে সারাক্ষণ ডুবে থাকে। ফলে সন্তানকে তারা সময় দিতে পারে না। তারা কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কী করছে এসব দিকে খেয়াল না রাখা -সবার অজান্তেই পরিবার থেকে সন্তান এক ধরনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পরিবারবিমুখ হয়ে অ্যাডভেঞ্চারের নামে তারা এভাবে বিপথগামী হয়ে পড়ে। আর তার মাশুল দিতে হচ্ছে সমাজকে ।

প্রমথ চেীধুরী তার ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে বলেছিলেন-লেখাপড়া হতে হবে আনন্দের সহিদ, যেন শিক্ষার্থীর হৃদয় পর্যন্ত সেটা পৌঁছতে পারে। কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর হৃদয়ের দরজার সন্ধান আজো পেয়েছে কি-না তা প্রশ্নাতীত। তারপরও অনেক শিক্ষার্থী স্কুল কলেজের আঙ্গিনা পেরিয়ে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু এই পর্যায়েও এই ব্যবস্থা না বললেই চলে। শিক্ষক তার মন গড়া ক্লাশ নিচ্ছে। এসব শিক্ষকের যোগ্যতা আর দক্ষতা নিয়েও রয়েছে বির্তক। দলীর ব্যানারে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক। ছাত্ররা নিভিরর্শীল হরে পড়ছে শিক্ষককে লেকচার র্শীটে উপর। তার উপর রয়েছে শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতি, বিভিন্ন শিক্ষা বহির্ভূত কার্যক্রমের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার চরম আকার বিদ্যমান হচ্ছে।

গুলশানের হামলা, ঈদের দিনে হামলা এগুলো কিসের আলামত? বাংলাদেশে এমন এক সময়ে তারা এই জঙ্গি হামলা চালায় যখন দেশ উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে ধাবিত। দেশের এই অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করা, দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারের ভাবমূর্তি দেশ-বিদেশে ক্ষুণ্ণ করায় জঙ্গিদের প্রথম কাজ। এর আগে সারাদেশে বেশ কয়েকজন মুক্তমনা লেখক, সাহিত্যিক, অধ্যাপককে হত্যা, হিন্দু ধর্মের পুরোহিত, সেবায়েত, খ্রিস্টান ধর্মের যাজককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এসব জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর দৃঢ় অবস্থানের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে মানুষের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বাড়িতে-পরিবারে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং প্রতি পাড়া-মহল্লায় গণসচেতনতামূলক কর্মকা- পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে। হাত দিতে হবে উৎসে। তবেই জঙ্গিবাদের এ বিষবৃক্ষের শেকড়-বাকড় নির্মূল করা সম্ভব। আমরা দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি চাই, সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই। কোনো রক্তপাত, হানাহানি, দেশবাসী দেখতে চায় না।

সর্বোপরি- এখনই তৃণমূল থেকে সমাজের আমূল সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। তবেই মিলবে কাক্সিক্ষত সমাধান। নয়তো ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে আরও ভয়ংকর।

11141777_836056429808622_4762140710039098174_n

মো. বশিরুল ইসলাম। এ্যসিস্ট্যন্ট রেজিস্ট্রার এন্ড ইনচার্জ ,পাবলিক রিলেশন  ডিপার্টমেন্ট, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

পছন্দের আরো পোস্ট