নারীর নির্যাতন বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরী

atik দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে যে নারীদের রয়েছে বিরাট অবদান। তাদেরকে কি আমরা সেই মর্যাদার আসনে বসাতে সক্ষম হয়েছি? যদিও আমাদের দেশের নারীদের মন-মানসিকতা এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের সাফল্য ও অগ্রগতি যা আমাদের মনে দারুন আশার সঞ্চয় করে। এখন আমাদের দেশের নারীরাও পুরুষদের সমপরিমান কাজ করতে সক্ষম। দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারখানায় বিভিন্ন পেশায় এমনকি দৈনন্দিন মজুরীর ভিত্তি মাঠে-ঘাটে তারা পুরুষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করছে। যা দেশের সার্বিক অর্থনীতি উন্নয়নে ইতিবাচক।

Post MIddle

আজ দেশের পোশাক শিল্পে শতকরা ৯৫ ভাগ নারী শ্রমিক উপস্থিতি মূলত: এমনিই ইঙ্গিত বহন করে। এইসব নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এ সমাজে আমরা এখনও কি নারীদের সেই যোগ্য অধিকার ও কর্মক্ষেত্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা ও হয়রানি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছি? প্রতিনিয়ত এ সমাজে একশ্রেণীর মানুষরুপি হায়েনাদের হাত থেকে আমরা কি নারী-যুবতীদেরকে মুক্তি করতে পেরেছি? কর্মক্ষেত্রে নারীদের সার্বিক নিরাপত্তা ও কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে কি সক্ষম হয়েছি? হয়নি, বর্তমানে এ সমাজে সভ্য নরপশু ও পাষন্ডদের দ্বারা পদে পদে কর্ম ক্ষেত্রে নারী ও পথে ঘাটে যুবতিরা এখনও নানান বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অকালে প্রাণ দিচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেছের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশার নির্মম হত্যাকান্ডের মত ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আবারো আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে ছিল সমাজে নারীরা কতটুকু নিরাপদ? রিশার এই নির্মম হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক এবং তার পরিবার সুবিচার পাক এমনটিই প্রত্যাশা করি।

বর্তমানে পুরুষ শাসিত সমাজে ঘরে যেমন নারীরা স্বাধীন নয়। ঠিক তেমনি বাইরে ও কর্মস্থলে তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অনেক সময় বসদের অনৈতিক নির্যাতন তারা একপ্রকার মান সম্মানের ভয়ে তা হজম করতে বাধ্য হচ্ছে। নারীদের দারিদ্র্যের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একশ্রেণী ভদ্রবেশী নরপশুরা কাজ দেওয়ার নামে প্রতিনিয়ত নারীদের শোষণ ও নির্যাতন করছে। এখনও এদেশের নারীরা কর্মস্থলে বসদের হাতে জ্ঞাত -অজ্ঞাত ভাবে নানা রকম যৌন ও নানাবিদ হয়রানি স্বীকার হচ্ছে।

তাদের এই নির্যাতন মূলত: নারী আর্থিক দৈন্যতা ও চাকুরি হারানোর ভয়ে তা মুখবুঁজে সহ্য করছে ও নীরবে নিভৃর্তে চোখের জল ফেলছে। চাকুরি খাওয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের সঙ্গে এই ধরনের অনৈতিক চর্চা করে যাচ্ছে। প্রতিকার ও নারীরা সোচ্চার না হওয়ায় কর্মস্থলে নারীদের ওপর এইরূপ নির্যাতন ও অসহায়ত্ব দিনদিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা দেশে নারী পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধান অন্তরায়।

কর্মস্থলে নারীরা একপ্রকার ইচ্ছার বাহিরে আর্থিক দৈন্যতা থেকে সংসার প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে অথবা সংসারের ভোরণ-পোষনে ব্যর্থ জীবনসঙ্গীদের কিছুটা সাহায্য এবং নিজেদের অর্থনীতির মুক্তির জন্য এমন নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। নারীদের আর বসে থাকলে চলবে না অফিস-আদালত, শিল্প-কল কারখানা অথবা অন্য যেকোন স্থানে নারীদের উপর বসদের এই ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ ও যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নিজেদের সম্ভ্রম নিজেদেরকেই রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে বসদের এধরনের যৌন নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য প্রমান সাপেক্ষে যথাযথ আইনের আশ্রয় নিতে হবে।

সমাজে এই ধরনের ভদ্র নরপশু বসদের মুখোঁস খুলে ফেলতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কৌশলের সঙ্গে বসদের এই ধরনের অনৈতিক চাওয়া-পাওয়াকে যতটুকু সম্ভব মোকাবেলা করতে হবে। না পারলে তাদের বিরুদ্ধে প্রমান সাপেক্ষে লিখিত অভিযোগ আনতে হবে। বিড়ালের গলায় ঘন্টা পরাতে একজন না একজন কে তো দায়িত্ব নিতেই হবে। চক্ষু লজ্জার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে প্রতিনিয়ত নারীদেরকে এমন নির্যাতন সহ্য করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বসদের এহেন আচরণ কাম্য হতে পারে না। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য নারীদেরকে বলিষ্ট ভুমিকা পালন করতে হবে।

কর্মস্থলে নারীদের কাজের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান ও যৌন নির্যাতন বন্ধে নারী সমাজকে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অনুরূপ কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি পুরুষদের অধিক শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে এই ধরনের অনৈতিকতা চাওয়া-পাওয়া গুলো পরিহার করতে হবে। যা প্রতিষ্ঠানের সাফল্যে অধিক জরুরী বলে মনে করি। বিশ্ব যখন অবাধ গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে নারীরা যখন প্রশাসন, নীতিনির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ, বৈমানিক, সৈনিক, প্রকৌশলী, আইনজীবী হচ্ছে তখন আমাদের দেশের নারীরা যদি বসদের এইরূপ অনৈতিক চাওয়া-পাওয়ার কাছে প্রতিনিয়ত পরাজিত হয় অথবা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ঘরে বসে থাকলে তবে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও সার্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পরবে এবং সমাজও বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে পরবে।

যদিও বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সম অধিকার ও উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে বিপরিতে একশ্রেণীয় রাজনীতিক কর্মকান্ড ও রাজনৈতিক সমাজ নির্মানে ধর্মজ বাঁধা ব্যবহার করে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বসদের অনৈতিক কার্যকলাপের দরুন দেশের উন্নয়নের ধারা ক্রমেই পিছিয়ে পরচ্ছে। যা দেশের নারী ক্ষমতায়নে বড় ধরনের বাঁধা বলে মনে করি।

যদিও এই কথাটি আমাদের প্রায় সবাই জানা, দেশের উন্নয়ন সফলতা নির্ভর করে মূলত: নারী পুরুষের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে নারীদের সমঅধিকার এখন এ সমাজে পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশে নারীরা নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের পেশা ও কর্মজীবন বেছে নিচ্ছে এবং পুরুষদের সম অধিকার দাবি করছে। কিন্তু পুরুষ শাসিত আমাদের এই সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে আজ নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যদিও কয়েক দশক আগেও এদেশে কর্মক্ষেত্রে শুধু পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল। সংবিধানে নারী ও পুরুষ সর্বস্তরে সমঅধিকার লাভ করায় এদেশের নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করতে বেরিয়ে পরেছে।

পুরুষদের কর্মস্থলে নারীদের এই উপস্থিতিই মূলত: নারীদের বহুবিদ নির্যাতনের প্রবণতার উৎপত্তি ঘটাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে কর্মক্ষেত্রে নারীরা কোন না কোন সময় ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় বাহিরেও নানামুখী নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে এই ধরনের নির্যাতন শুধুমাত্র নারীর মর্যাদাই ক্ষুন্ন করে না, প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের ভিতরের পরিবেশটাকেও ভীষন ভাবে দূষিত ও কুলষিত করে। বিশেষ করে আমাদের সমাজে কর্মস্থলে নারীদেরকে দুইভাবে নির্যাতিত হতে দেখা যায়। কিছু পাওয়ার জন্য কিছু দেওয়ার মানসিকতা এক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে নারীদের যৌন আনুকুল্য দেখাতে হবে অন্যজনের কাছ থেকে কর্মক্ষেত্রে তার প্রতি অনুকুল ব্যবহার ও সকল ধরনের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য। কর্মস্থলের বসদের নিকট থেকে এই ধরনের প্রস্তাব কখনও কাম্য হতে পারে । যা হয়তো প্রত্যাখ্যান করলে কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানি অথবা চাকুরী হারানোর মতো পরিস্থিতি দুইটিই সৃষ্টি হতে পারে।

1

দেশের সরকারি অফিস-আদালতগুলির চাইতে বেসরকারি অফিস-আদালতগুলিতে কর্মস্থলে নারীদের এই ধরনের পরিস্থিতির স্বীকার বেশী হতে হচ্ছে। যা প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ ও তথ্য দেখে সহজেই প্রতীয়মান হয়। যদিও দেশের সব প্রতিষ্ঠানের বসদের আচরণ এক রকম নয়। নারীদের প্রতি প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এই ধরনের আচরণ মোটেও সমীচীন নয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে আবার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে এই ধরনের আচরণ না থাকলেও কর্ম পরিবেশে এক রকম ভাবাপন্ন পরিস্থিতি যেখানে যৌন প্রকট কথাবার্তা, যৌন-উদ্দীপনা, অশ্লালীন ভাবভঙ্গি ও অশ্লীল ছবি দেখানো, স্পর্শ করার বিষয়গুলো জড়িত থাকে যা ধীরে ধীরে এই ধরনের যৌন নির্যাতনের দিকে ধাপিত হয়। এক পর্যায়ে নারীরা কর্মস্থলে পুরষদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়।

যদিও কর্মস্থলে সব পুরুষরাই নারীদের প্রতি এরূপ আচরণ করে না, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বিশেষ করে এই ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। যা প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের পথে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি। অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে নারীরা অতিরিক্ত সুবিধা ও প্রমোশন নিতে অথবা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি হারানোর ক্রমাগত চাপ কমাতে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা অনৈতিক নানাবিদ নির্যাতনের স্বীকার হয়। নারীদের এই চাওয়া-পাওয়ার বিপরিতে প্রতিষ্ঠানের বসরা এই ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপে আরো অধিক আকৃষ্ট হচ্ছে।

ফলে এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃংখলা, সার্বিক কাজের পরিবেশ মরাত্নক ভাবে বিঘ্নিত হয়। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে বসদের এই ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপযুক্ত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত ও যৌনসহ সকল ধরনের অনৈতিক নির্যাতন বন্ধে নারীদের আরো সচেতন ও কৌশলী হওয়া যেমন জরুরী ঠিক তেমনি নারীদের সার্বিক নিরাপত্তা দানে প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি সৎ মনোভাব আনায়ন এবং অসৎ উদ্দেশ্য থেকে চিরতরে বিদায় দেওয়া জরুরী।

দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে নারী পুরুষের সম অধিকার নিশ্চিত করতে সকলকে নারীদের প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল হওয়াকে অধিক জরুরী বলে মনে করি। কর্মক্ষেত্রে নারীদের এই অবস্থার পরিত্রানে সহযোগিতার হাতকে সম্প্রসারণ করে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সার্বিক সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

—————————————————————————————————-
সমাপ্ত // কলাম লেখক, উত্তরা , ঢাকা। atik@bift.info

পছন্দের আরো পোস্ট