একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের গল্প

২০ বছর আগের ঘটনা। হাই স্কুল শিক্ষক সেলিম উদ্দিন । দুই কন্যা ও এক পুত্র ও স্ত্রী সহ ৫ জনের সংসার। মেয়ে দুটি কলেজে ও ছেলে স্কুলে পড়ে। সন্তানদের ভালো স্কুল কলেজে পড়ানোর জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে ভাড়া বাসায় থাকেন। তখন হাই স্কুল শিক্ষকরা বেতন পেতেন দুই তিন মাস পর । প্রাইভেট টিউশনি করে কোনমতে সংসার চলে। বেতনের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হতো মাসের পর মাস। তিনি আমার বাবা।

Post MIddle

একদিন তিনি ২৫ কিলমিটার দূরে ব্যাংকে তার বেতন উত্তোলন করতে গেলেন। সকাল থেকে সারাদিন আমরা (তার সন্তানেরা) পথ চেয়ে বসে আছি। বাবা কখন আসবে? আজ বাবা বেতন পাবে, নিশ্চয় ভালো বাজার করে নিয়ে আসবে। পরেরদিন স্কুলের টিফিনের ২ টাকা খুব সহজেই নেয়া যাবে। নানা আবদারের জাল বুনতে বুনতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। সন্ধ্যা হলো।

মা আনেক চিন্তিত, কোথায় গেল, কি হলো ! তখন মোবাইলে ফোনের যুগ ছিল না। সেই সময় রাত ১০টাতে অনেক রাত মনে হতো। মা দরজার সামনে যেয়ে দাড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে আর দোয়া পড়ছে। আমরাও মাকে চিন্তিত দেখে ঘুমোতে পারছি না। সবাই চুপচাপ বসে আছি। আমি তখন অনেক ছোট । ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ি। রাত ১২ টা বাজার পরও ঘুম আসে না। বাবার জন্য আমিও খুব চিন্তিত ছিলাম। আমার বড় বোন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে।

ঠিক এমন সময় বাবা দরজার কড়া নারলেন। আমরা বাবার গলার আওয়াজ শুনে সবাই লাফ দিয়ে দরজার সামনে গেলাম। বাবার চেহারা মলিন। খুব ভারী গলায় কথা বলছে। মা রাগ করে বললেন, সারাদিন কোথায় ছিলে? বাবা চুপ। আমরাও জিজ্ঞেস করলাম কোথায় ছিলেন বাবা? মা বাবাকে বললেন ছেলে মেয়েরা সারাদিন অপেক্ষায় আছে তুমি আজ ভালো বাজার করে আনবে। আর তুমি এখন খালি হাতে আসলে। ঠিক আছে কাল সকালে বাজার করো। বাবা কোন কথা বলছেন না, তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। বাবার কান্না দেখে আমার বড় বোনও কেঁদে ফেললো। বাবা কাদতে কাঁদতে বললেন, ব্যাংক থেকে বেতন উত্তোলন করে বাসে চড়ে বাসায় আসছিলাম । বেতনের সব টাকা পকেট মার হয়েছে।

বাস থেকে নেমে যখন পকেটে হাত দিয়ে দেখেন তার টাকা নেই, তখন দিশেহারা হয়ে চারিদিক ছোটাছুটি করেছেন, খুজে বেড়িয়েছেন পকেটমারকে। যেখান থেকে বাসে উঠেছেন সেখানে আবার গিয়েছেন। অবশেষে খালি হাতে বাড়ি ফিড়েছেন। বাবার চোখের পানির কষ্ট সেদিন বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি টাকা হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট। বাবা সেদিন চোখের পানি ফেলেছিলেন একমাত্র আমাদের জন্য। অনেক দিন ধরে তিনিও প্রতিক্ষায় ছিলেন বেতন পেয়ে আমাদের কিছু ভালো খাওয়ার খাওয়াবেন। আমাদের কিছুটা স্বাধ পুরন করবেন। আমাদের পোশাক-আশাক কিনে দিবেন। বাবা কখনও তার নিজের পোশাকের দিকে তাকাতেন না, তার ব্যাবহারের স্যান্ডেলটিতে এমন কোন জায়গা ছিল না, যেখানে সেলাই করতে বাকি আছে। আমি এখন বাবার পেশাই বেছে নিয়েছি। বাবার ইচ্ছা ছিল না আমি শিক্ষক হই। কারন বাবা চাইনি তার মতো আমিও কষ্ট করি।

বাবা চাকরির শেষের ৫ বছর আগে উচ্চতর বেতনের জন্য বিএজিএড করলেন। এরপরও বাবা তার উচ্চতর বেতন স্কেল বের করতে পারলেন না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটি অসহযোগীতামূলক আচরন শুরু করলেন। এমপিওভুক্ত চাকরি ! নানা কায়দা- কলম দেখিয়ে তারা আমার বাবাকে বলেছিলেন আপনাকে আবার নতুন করে এই স্কুলে কৃষি শিক্ষা বিষয়ে নিয়োগ নিতে হবে। উল্লেখ্য, আমার বাবা একই স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। তারা বিভিন্ন কায়দায় নিয়োগের ব্যাবস্থা করে আমার বাবার কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিলেন।

বাবা নিরুপায় হয়ে কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে তাদের টাকা দিয়ে একই স্কুলে নতুন নিয়োগ নিলেন। নতুন স্কেল ধরাতে পারলে চাকরি শেষে আবসরের টাকা দ্বিগুন পাবেন। এই ভেবে তিনি ধার দেনা করে টাকা জোগাড় করে তাদের হাতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার নতুন নিয়োগ হওয়ার পরও মাঊশি থেকে স্কেল পরিবর্তন করতে পারলেন না। সেখানেও অনেক নাটক। এই মাস না পরের মাস, এভাবে দেড় বছর পার হয়ে গেল। বাবা তবুও স্কেল পেলেন না।

অবশেষে স্কেল না পেয়েই আগস্ট ২০১২ তে চাকরি শেষে অবসরে গেলেন। আমার বাবা তার স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক ছিলেন। অথচ তার বিদায় উপলক্ষে সৌজন্যমূলক বিদায় অনুষ্ঠানও করেনি প্রধান শিক্ষক। ঘরে একটি বিদায়ী মানপত্র টাঙানোর স্বপ্নও তার পূরন হয়নি। চাকরি শেষে বাবা দিন গুণতে গুণতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। কবে টাকা পাবেন। অতিরিক্ত চিন্তায় একবার স্ট্রোকও করেছেন। আমি এখন স্বাবলম্বী। বাবার সকল চাহিদা পূরন করতে যেন সমস্যা না হয় তাই বাবা মা কে শহরে আমার কাছেই রেখেছি। কিন্তু বাবা তার নিজের কষ্টার্জিত টাকার কথা ভুলতে পারেন না। কবে পাবেন তার প্রতি মাসের বেতন থেকে কর্তন করা অবসরের টাকা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশে আমার বাবার মতো অনেক শিক্ষক তাদের অবসরের টাকার জন্য অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে মারাও গেছেন। তাদের জীবন কি এমনই থাকবে? আপনার হাজারো যুগান্তকারী পরিবর্তনের সাথেসাথে সামান্য সম্মতি দিলে অবসর সুবিধা বোর্ডেও ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকরা দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারেন! যে সমস্ত শিক্ষকরা অবসররের টাকা না পেয়েই দুনিয়া ত্যাগ করেছেন তাদের আত্মাও শান্তি পাবে! ##

লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান শামীম, শিক্ষা শ্রমিক, ভেড়ামারা কলেজ, কুষ্টিয়া।

পছন্দের আরো পোস্ট