গৌরবোজ্জল পথচলার ৫৬ বছরে বাকৃবি

BAUমানবসভ্যতার পথচলার সূচনা কৃষির হাত ধরে। মানব জীবনের অস্তিত্বকে অর্থবহ করতে কৃষির ওপর নির্ভরতা সময়ের সঙ্গে পাল্টা দিয়ে বেড়ে চলেছে। আজ অবধি তাই কৃষিই আমাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন। বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির প্রধান পরিচয়ও কৃষি। বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা কৃষিকেন্দ্রিক। দেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির মাঝেই নিহিত রয়েছে গোটা জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি। কৃষিভিত্তিক উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ৫৫ বছর পেরিয়ে ৫৬ বছরে পদার্পণ নিঃসন্দেহে বিশাল অর্জন। সুদীর্ঘ এ পথপরিক্রমায় সাফল্য ও সম্ভাবনার খেরোখাতায় যোগ হয়েছে নানা অধ্যায়।

উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ও গবেষণা প্রসারের লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছিল, তার ওপর ভিত্তি করে ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দক্ষিণে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে ১২০০ একর এলাকাজুড়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

কৃষি খাতকে পূর্ণতা দেওয়া এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে ৫৪ বছর ধরে গৌরবের স্মারক হয়ে জ্বলজ্বল করছে। দেশের প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিশিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ বিদ্যাপীঠ বলে পরিগণিত। প্রতিষ্ঠাকালে মাত্র দুটি অনুষদ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা বাকৃবিতে বর্তমানে ছয়টি অনুষদে কৃষিবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আহরণের সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা সুযোগ-সুবিধার অভাবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাবিমুখতার বিষয় আমাদের জানা, কিন্তু বাকৃবি এক্ষেত্রে ভিন্ন নজির স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে দেশে যত গবেষণা পরিচালিত হয়, তার সিংহভাগই বাকৃবিকেন্দ্রিক। নতুন ও সহজতর কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বাকৃবির কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই।

দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট সমস্যায় জর্জরিত, অথচ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের বালাই নেই। সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে হরতাল বা অন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে একদিনের জন্যও বন্ধ হয় না বাকৃবির শিক্ষা কার্যক্রম। গর্বভরে বলা যায়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ৫৩ বছর পূর্ণ করছে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম মিলনস্থল বাকৃবি।
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাওয়া থেমে নেই। কালের পরিক্রমায় বাংলাদেশে কৃষিশিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে পথিকৃৎ, পূর্ণাঙ্গ ও প্রধান বিদ্যাপীঠ হিসেবে বাকৃবি আজ গর্বিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জনের ধারা বজায় রেখেছে। মানসম্পন্ন উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশে কৃষি উন্নয়নের গুরু দায়িত্ব বহনে সমর্থ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ তৈরি করাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য।

Post MIddle

‘খাদ্যনিরাপত্তা’ নামে যে ইস্যুটি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শোনা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বাকৃবি অগ্রণী ভূমিকা পালনে সর্বদা তৎপর। আধুনিক বিশ্বের ৪৭টি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক উন্নয়নশীল একটি দেশ হিসেবেই এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের কৃষি সংস্কৃতিতে বারবার আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে দারিদ্রতা দূরীকরণের প্রত্যয়ে দেশের শক্তিশালী আর্থসামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাকৃবির প্রয়াস অগ্রগণ্য। আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আপন মর্যাদায় আসীন। নতুন ও সহজতর কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বাকৃবির কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কৃষি উন্নয়নে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে উন্নত জাতের ফল-ফসল উদ্ভাবন, মাছের উন্নত প্রজাতি ও চাষের সহজ প্রযুক্তি প্রবর্তন, প্রাণিচিকিৎসা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতিতে বাকৃবির অবদান অনস্বীকার্য।

প্রচলিত, অপ্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় দেশী-বিদেশী ফল গাছের দেশের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা জার্মপ্লাজম সেন্টারের অবস্থান বাকৃবিতে। মোট ২০ একর জায়গায় বিস্তৃত ফলের এ সংগ্রহশালা। এ ক্যাম্পাসে অবস্থিত দেশের প্রথম এবং একমাত্র কৃষি জাদুঘর। কৃষি বিবর্তনের ইতিহাস কৃষি উপকরণ এবং কৃষি উপকরণ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারণা দিতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এ জাদুঘর। জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে দেশের সেরা বোটানিক্যাল গার্ডেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। সহস্রাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এ গার্ডেনে। বাকৃবিতে রয়েছে একটি বৃহৎ দুগ্ধ খামার, পোলট্রি খামার, মৎস্য খামার, কৃষি খামার, ফিড মিল, মৎস্য হ্যাচারি, গো-ছাগলের জাত উন্নয়ন কেন্দ্র, ভেটেরিনারি ক্লিনিক এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হোসেন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে গর্ব করার মতো একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। দেশের নদ-নদী, খাল-বিল থেকে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মাছ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের সংগ্রহ নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে ‘ফিশ মিউজিয়াম অ্যান্ড বায়োডায়াভারসিটি সেন্টার’।

শিক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামেও বাকৃবির গৌরবোজ্জ্বল অবদান আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেও ১১ দফার ভিত্তিতে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আন্দোলন ও ত্যাগের ইতিহাস। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হারায় তার ১৮ বীর সন্তানকে। তাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের পেছনে নির্মাণ করা হয় ‘মরণ সাগর’ স্মৃতিসৌধ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শহীদ ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার নামে তিনটি হলের নামকরণ করা হয়। ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ এবং বিজয় ’৭১ নামে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নির্মিত বধ্যভূমি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

এছাড়া দেশের কৃষি সম্পর্কিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) প্রধান কার্যালয় বাকৃবির সবুজ ক্যাম্পাসেই অবস্থিত।

পেশাগত শিক্ষা হিসেবে কৃষিবিজ্ঞানের সব শাখায় উচ্চতর শিক্ষাদান, প্রায়োগিক ও মৌলিক গবেষণা পরিচালনা, সম্প্রসারণ ও সংশ্লিষ্ট গঠনমূলক কার্যক্রম সংগঠন ও তত্ত্বাবধান, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তাসহ কৃষক ও আদর্শ চাষীদের জন্য কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান এবং বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক যৌথ সহযোগিতামূলক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষি তথা কারিগরি ক্ষেত্রে কর্মের সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা আরো বেগবান করা হলে কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিগত অর্ধশত বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য পরবর্তী দিনগুলোয়ও সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে। গুণে-মানে-সৃষ্টিতে সত্যিকার অর্থে কৃষিশিক্ষার তীর্থ বিদ্যাপীঠ হয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে রাখবে অগ্রণী ভূমিকা, এ প্রত্যাশা সবার।#

পছন্দের আরো পোস্ট