নতুন রূপে ইবির আইন বিভাগ

সেশন জট শব্দটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন তরকারীতে আলুর মতো। এমন কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই যা শতভাগ সেশনজট মুক্ত। ন্যূনতম একমাসের সেশনজট থাকলেও আছে। মামলা জট, যানজট এমনকি সাধু শ্রেণীর চুলের জটের মতই দূর্বিষহ বিড়ম্বনার অপর এক নাম এই সেশনজট। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল চুড়ান্ত না করার ফলে তৈরী হয় এই সখের বশে ঢেঁকি গেলা সংকট। চোখ কান বন্ধ করেই শিক্ষার্থীরা মেনে নেয় নিজের জীবন থেকে বৃথা সময় বয়ে যাওয়ার এক অলিখিত সন্ধি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগে রয়েছে সেশনজট। দুমাস চারমাস এমনকি তিন বছরের সেশনজটের নজীর রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শিক্ষকদের অনিয়মিত কর্মতৎপরতা, রাজনৈতিক ছাত্রদের অনৈতিক আবদার সহ নানাবিধ কারণে সেশনজটের মাত্রা যেন বেড়েই চলছিলো। তবে গত দু বছরে উল্লেখযোগ্য কোন অনির্ধারিত ছুটি না থাকায় সেশনজট নিরসনে অনেকটা এগিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কবলিত বিভাগগুলোর মধ্যে তেমনিই প্রথম সারির একটি বিভাগ “আইন ও মুসলিম বিধান বিভাগ”।

“বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৮৭-৮৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে আল-কানুন ওয়াস শরিয়াহ নামে এই বিভাগের গোড়াপত্তন। বিবর্তনের ছোঁয়ায় ল এ্যান্ড শরিয়াহ থেকে তৃতীয় দফায় পরিবর্তন হয়ে বিভাগের নাম এখন আইন ও মুসলিম বিধান।” প্রতিষ্ঠাকালীন এই বিভাগের দ্বিতীয় ব্যাচের মেধাবী ছাত্র ও বর্তমানে বিভাগে শিক্ষকতায় নিয়োজিত প্রফেসর ড. আক্রাম হোসাইন মজুমদার এভাবেই বিভাগের অতিত ইতিহাস তুলে ধরেন।

তিনি আরো বলেন-“বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তর হওয়ার পর ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা হয়নি। এরপর নানা কারণে বিভাগে সেশন জট শুরু হয়। প্রথম দিকে আইন বিভাগে সেশনজট তেমন না থাকলেও ১৯৯৯-২০ সালের পর শিক্ষক সংকটের কারণে মুলতঃ সেশন জট প্রকট আকার ধারণ করে। তবে বর্তমানে শিক্ষকদের আন্তরিকতায় সেশনজট কমে এসেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আইন বিভাগকে সেশনজট মুক্ত বিভাগ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।”

“নতুন শিক্ষকদের নিয়োগ হওয়ার পর ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিতকরণে বিভাগে ব্যাপক গতি ফিরে এসেছে। এছাড়া বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকরাও সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ শুরু করেছে। শিক্ষকদের মধ্যে নীতিগত ঐক্যমতের গতি সমুন্নত রয়েছে। দিনে দিনে তা আরো বেগবান হচ্ছে। বিভাগ নিয়ে আগে হতাশায় ভুগলেও এখন গর্ববোধ করি। আগামীতে যারা এই বিভাগে ভর্তি হবে তারা হবে প্রকৃত উপকার ভোগী।’ কথা গুলো বলছিলেন বিভাগের এলএলবি চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী শাকিলা পারভীন মনি, নিয়ামুল হাসান, গালিব, বনানী আফরিন ও মশিউর রহমান আকাশ।

বিভাগে বর্তমানে সাতটি ব্যাচ থাকলেও চলতি বছরের শেষের দিকেই দুটি ব্যাচ এলএলএম শেষ করবে বলে বিভাগীয় প্রধান আশা ব্যক্ত করেছেন। ফলে আগামী নতুন বছরের শুরু থেকেই সম্পূর্ণ সেশনজট মুক্ত বিভাগ হিসেবে পূণঃযাত্রা শুরু করবে বিভাগটি। এমনই প্রত্যাশা বিভাগের সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের। এলএলএম অধ্যয়নরত তানভীর আহমেদ, রিপা খাতুন, আনিকা তাবাসসুম ও সিরাজুম মনিরা বলছিলেন-“২০১০ সালে ভর্তির সময় বিভাগে সেশনজটের যে অবস্থা ছিল তা দেখে আমরা রীতিমত হতাশা হয়ে গিয়েছিলাম। তখন প্রায় তিন বছরের সেশনজট ছিল। তবে শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা এক বছরের একটু বেশি সময় নিয়ে এলএলএম শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি।”

Post MIddle

বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্লাস রুটিন, একাডেমিক ক্যালেন্ডার ও সিলেবাস প্রণয়ণের পর নির্ধারিত সময়ে সব ব্যাচের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। ফলে চলতি বছর শেষে আর কোন সেশনজট থাকবে না আইন বিভাগে। বিভাগের শিক্ষকরাও এখন উত্তরপত্র মূল্যায়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, ক্লাস সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বেশ আন্তরিক। সকল শিক্ষকই একযোগে কাজ করছেন বিভাগ থেকে সেশনজটের ছায়া মুছে ফেলার প্রত্যাশা নিয়ে।

শুধুমাত্র সেশনজট নিরসনেই বিভাগটি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে তা কিন্তু নয়। ক্রীড়াঙ্গন, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে আইন বিভাগ। আন্তঃবিভাগ ক্রিকেটে টানা দুই বারসহ ফুটবলে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বিভাগটি। জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অন্যতম খেলোয়াড় ফাহিমা খাতুন এই আইন বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। এ্যাথলিট ফিরোজ, তাসলিমা খাতুন, ফুটবলার রয়েল, সবুজ, বেলাল, মেসি খ্যাত মাসুম, ক্রিকেটে মিস্টার ডিপেন্ডেবল খ্যাত নাঈম, মুরালীধরণ খ্যাত ইকো’দের মত জাতীয় পর্যায়ের ক্রিড়াবীদরা এই আইন বিভাগে অধ্যয়ণরত রয়েছে।

বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. সেলিম তোহা বলেন-“আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, ডিবেটিং, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডসহ এক্সট্রা কারিক্যুলার এক্টিভিটিজ এ সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। খেলোয়াড়দের ব্যাপারে শিক্ষকদের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে তারা এই বিভাগে ভর্তি হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন ক্রীড়াবীদ রয়েছে এই বিভাগে। আইন শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে সকল ক্ষেত্রের জন্য যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকরা একাত্ম হয়ে কাজ করছে।”

এছাড়া বিভাগে এখন সব থেকে নজরে পড়ার মত বিষয় হলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো বিভাগের মধ্যে সর্বাধুনিক এই বিভাগে রয়েছে ডিজিটাল সেমিনার লাইব্রেরী। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত লাইব্রেরীতে রয়েছে উচ্চ গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগসহ ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব। দেশ-বিদেশ থেকে নানা ধরণের বিখ্যাত আইনী বই পুস্তক সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ করা হয়েছে লাইব্রেরীকে।

এমনকি প্রত্যেক শিক্ষককের ব্যক্তিগত অফিসেও দেয়া হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার। বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ অফিস, প্রত্যেকটি শ্রেণীকক্ষ ও করিডোর এখন সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া মুট কোর্ট ট্রেনিংয়ের জন্য রয়েছে নিজস্ব শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মুট কোর্ট গ্যালারী। যেখানে বিভাগের শিক্ষার্থীদেরকে বিচারক ও পেশাজীবী আইনজ্ঞদের সামনে হাতে কলমে বিচারিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হয়।

বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জহুরুল ইসলাম তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন-বিভাগের শ্রদ্ধাভাজন সকল শিক্ষকের সহযোগিতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ইউজিসির উচ্চ শিক্ষা মান উন্নয়ন প্রকল্পের আর্থিক অনুদানে ইবি আইন বিভাগ হবে একটি মডেল বিভাগ। এ বিভাগের থাকবে বহি:বিশ্বের সাথে সহযোগিতা চুক্তি যা এখন অনেকটাই এগিয়ে। বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশনের প্রথিকৃত হতে চলেছে এই বিভাগ। ইতোমধ্যে আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ল স্কুলের সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে আইন বিভাগ।

বিভাগের বর্তমান একাডেমিক অবস্থা নিয়ে তিনি আরো বলেন- আইন বিভাগের ইতিহাসে ২০১৬ সালের ১ম বর্ষ অনার্স পরীক্ষা ২০১৬ সালেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ২০১৫ সালের অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং ২০১৫ সালের মাস্টার্স চূড়ান্ত পরীক্ষা ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত হবে। আর ২০১৭ সালের মধ্যে সেশন জট শূণ্যতে নেমে আসবে। এটা এখন শুধু স্বপ্ন নয় এটা আইন বিভাগের শিক্ষকম-লীর অগ্রগতির বাস্তবতা। পূর্বে বিদ্যমান অর্ডিন্যান্সের রক্ষণশীল ব্যাখ্যা আমাদেরকে পিছিয়ে দিলেও ইতিবাচক ব্যাখ্যা আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবে এর কোর্স কারিকুলামের ব্যাপক পরিবর্তন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অতি দ্রুত টিচিং ম্যাটেরিয়াল্স সহ আধুনিক কোর্স কারিকুলাম প্রণীত হবে যা বিভাগকে অতি দ্রুত উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করবে। সেজন্য প্রশাসনসহ সকল মহলের সহযোগিতা তিনি কামনা করেন।#

পছন্দের আরো পোস্ট