ইচ্ছার অপমৃত্যু । ড. সালেহ মতীন

561731_517144371637395_152385355_nইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা মানুষকে সর্বক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। এর মাত্রা যখন সর্বোচ্চ হয় কিংবা গুরুত্বের বিচারে এটা যখন সবার উপরে অবস্থান করে তখন এটাকে আমরা বলি স্বপ্ন। ছোট হোক কিংবা বড় হোক কোন ইচ্ছা যখন স্বপ্নের মর্যাদা লাভ করলে তখন সেটি মানুষকে ভিন্ন শক্তিতে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

Post MIddle

ইচ্ছার জীবনচক্র আছে, স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক গতিবেগও আছে। ইচ্ছার গতিবেগ যদি প্রবল মাত্রায় পৌঁছে স্বপ্নচূড়া স্পর্শ না করে তবে তা তার স্বাভাবিক গতিচক্রের কাছে হার মানতে বাধ্য। আবার কখনো কখনো এর অস্বাভাবিক পতনও ঘটে, যাকে বলা যায় অপমৃত্যু। মোটামুটি সচেতনভাবে পেছন ফিরে তাকালে সবাই দেথতে পাব যে, প্রচুর সংখ্যক ইচ্ছার অপমৃত্যুর সাক্ষ্য বহন করছি আমরা। আজকের জেগে উঠা প্রবল ইচ্ছা আগামী সূর্যোদয় পর্যন্ত জীবন্ত নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ সেটা হবে নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী বা স্বল্পজীবী ইচ্ছা। আবার কিছু ইচ্ছা আছে যা রাতারাতি নয় বরং কয়েক বছর আয়ুস্কাল পেতে পারে। ঈপ্সিত বিষয়বস্তুর প্রয়োজনীয়তা কিংবা তার সমসাময়িক গুরুত্বের উপর তার জীবনের মেয়াদকাল নির্ভর করে।

আমার জন্ম বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত একটি সবুজঘেরা গ্রামে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে প্রায় ৩০/৩২ বছর পূর্বের সেই শৈশবে গ্রাম্য বালকের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হতো। স্কুলে মাত্র তৃতীয় কি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলের পাশাপাশি অনুগত রাখাল বালক হিসেবে আমাকে বাড়ির কয়েক গজ দূর থেকে শুরু হওয়া সবুজ মাঠ/বিলে গরু চরানোর দায়িত্ব পালন করতে হতো। সাথে সমবয়সী আরো অনেকেই পারিবারিকভাবে অর্পিত এই একই দায়িত্ব পালনের জন্য জোট বাঁধত। গরুর ক্ষুধা নিবারণ ও তাদের নিরাপত্তা রক্ষার পাশাপাশি রাখাল বন্ধুরা মিলে দুষ্টুমী ও হরেক রকম খেলা করেই সময় পার করতাম।

এর মধ্যে যে বদঅভ্যাসটি আমাকে পেয়ে বসতো তা হলো রাস্তায় কাউকে ঘড়ি হাতে দেখলেই জিজ্ঞেস করে বসতাম- ‘কয়টা বাজে ?’ কেউ সুবোদ বালক মনে করে সুন্দর করে বলতো ‘বাবু …. টা বাজে।’ সাথে সাথে বলতাম, ধন্যবাদ। ধন্যবাদ দেয়ার সৌজন্যতাটুকু তখনও অর্জন করেছি সুস্পষ্ট মনে আছে।

হাফ প্যান্ট পরা গেয়ো এই রাখালের সময় জানার স্পৃহা সবার কাছে সমীহ আদায় করতে পারত না। পরিষ্কার মনে আছে কেউ কেউ বলেই বসত- ‘তোমার কয়টার দরকার ?’ বলতাম ১২টায় স্কুল তো। এ কথা শুনে শিক্ষার প্রতি তার কিছুমাত্র অনুরাগ জন্মাতো কিনা জানিনা- বলতো ‘এখনো ঘন্টাখানেক বাকী আছে। অকপটে স্বীকার করছি, সব সময় স্কুলে যাওয়ার নির্ধারিত সময় নির্ণয়ের চেষ্টা থেকে যে সময় জানতে চাইতাম এমনটি নয়। ঐ যে আগেই বলেছি- একটি বদঅভ্যাস আমাকে পেয়ে বসেছিল।

এই জিজ্ঞাসা শেষ অবধি বস্তুগত ইচ্ছার রূপ ধারণ করল। ভাবনা আমাকে পেয়ে বসল- আমার যদি একটি ঘড়ি থাকত- কবে আমার নিজের একটা ঘড়ি হবে ইত্যাদি। ভদ্রলোকদের চোখে চশমা দেখেও একই ভাবনা পেয়ে বসত। আমার যদি এমন একটা চশমা থাকত। নারিকেল পাতা দিয়ে ঘড়ি-চশমা দুটিই বানিয়ে আমরা শিক্ষিত ভদ্রলোক সাজার চেষ্টা করতাম। শিক্ষিত ভদ্রলোক এজন্য বললাম যে, সে সময় গ্রামের পরিবেশে সাধারণত শিক্ষিত জনেরাই ঘড়ি ব্যবহার করতেন। দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে চাইতাম- হে আল্লাহ ! তুমি আমার জন্য একটা ঘড়ি ও চশমা ফেলো না! সচেতনভাবে বহুবার এ প্রার্থনা করেছি মা‘বুদের কাছে। সে বয়সে দুই ঈদে সবার আগে খেলনা ঘড়ি ও চশমা কিনতাম। তাও আবার সে ঘড়ির কাটা ছিল স্থির। খানিক পর পর কাটা ঘুরিয়ে সময় এগুচ্ছে এটা প্রতিষ্ঠা করার ব্যর্থ চেষ্টা করতাম।

বাস্তবিক পক্ষে চশমা চোখে দেয়ার ইচ্ছা খুব একটা পুষ্টি অর্জন করতে না পারলেও ঘড়ির ইচ্ছাটা দিনের পর দিন স্বাস্থ্যবান হতে থাকে। নিজের হাতে ঘড়ি বেঁধে কীভাবে সেটি দেখে সময় বলব হাত ঘুরিয়ে তার রিহার্সেলও করতে থাকি মাঝে মধ্যে। অতঃপর পিতার ইন্তেকালের পর হেফজখানায় ভর্তি হই। সেখানকার ভিন্ন রকম কড়াকড়ির মাঝেও ঘড়ি হাতে দেয়ার ইচ্ছা তখনও আমার পিছু ছাড়েনি। দু’ টাকা চার টাকা করে পয়সা জমাতে থাকি যার মধ্যে আমার মায়ের অবদানই ছিল বেশি। একদিন দু’শো বাহাত্তর টাকা দিয়ে কিনি একটি রিকো ঘড়ি। কিন্তু ঘড়ি হাতে দেয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রযে গেল। হেফজখানায় ঘড়ি হাতে দেয়ার সুযোগ নেই। আমাদের হেফজখানায় তখন ঘড়ি হাতে দিয়ে বাবু সেজে মাতবরি করা, রূপ চর্চা, পেপার পড়াসহ আরো অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল।

শখের ঘড়িটিকে ট্রাংকের মধ্যে পুষতে থাকি। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেটাকে বের করে নাড়াচাড়া করে দেখি। মাঝে মধ্যে হাতে দিয়ে ঘুমাই। কিন্তু পাছে সাংঘাতিক ভয় কাজ করে যদি রাতে হুজুর দেখে ফেলেন। সকাল ৮টায় ঘড়িতে দম দেয়ার জন্য ইস্তেঞ্জার কথা বলে ছুটি নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঘড়িতে দম দিয়েই পাঞ্জাবীর পকেটে লুকিয়ে রাখতাম। এভাবেই চলত সাধের ঘড়ির সাথে অভিসারে আমার একান্ত আলাপন।

এরপর বছর খানেকের মাথায় হেফজখানার পাঠ শেষ করে বের হলে ঘড়ি হাতে দিতে আর কোন বাঁধা রইল না। তবে হুজুরের সাথে মাঝে মধ্যে যখন দেখা করতে যেতাম তখন ঘড়ি খুলে প্যান্টের পকেটে রেখেই তার সামনে যেতাম। অনেককে দেখতাম শার্ট কিংবা পাঞ্জাবীর হাতা কিঞ্চিৎ গুটিয়ে রাখত যাতে তিনি ঘড়ি হাতে দিয়েছেন তা লোকে বুঝতে পারে। কিন্তু আমি ঘড়ি হাতে দেয়ার স্বাধীনতা পেলেও পাঞ্জাবীর আস্তিনে তা ঢেকে রাখতেই পছন্দ করতাম।

Omega-Seamaster-300

এরপর পার হয়ে যায় অনেকগুলো বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি তাও প্রায় ১৫ বছর হয়ে গেল। আরো প্রায় ১ যুগ আগে থেকে ঘড়ির মোহ বিদূরিত হয়ে এর প্রতি ভয়ঙ্কর রকম বিস্বাদ শুরু হয়। নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আমার শৈশবের সেই প্রবল ইচ্ছার অপমৃত্যু হয়েছে। ২০০৩ সালে বিয়ের আসরে আমার মেহেদী মাখা হাতে শ্রদ্বেয় শ্বাশুড়ী আম্মা একটি সুন্দর ঘড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেদিন ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেটি হাতে ছিল। ২দিন পর প্রথম বারের মতো শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময় সৌজন্যতাবশত সেটি আরেকবার পরি। তারপর থেকে উপহারের ঘড়িটি আমার আলমিরায় ঘুমন্ত অবস্থায় বসবাস করছে। আমার বিয়ের প্রথম বর্ষপূর্তিতে শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে আরো একটি ঘড়ি উপহার দেয়া হয়েছিল (সম্ভবত ঘড়ির প্রতি আমার বিতৃষ্ণা বা বিস্বাদ সম্পর্কে তারা তখনো অবহিত হয়নি)। বলা বাহুল্য, তারও দশা পূর্ববৎ। এখন আমার অবস্থাটা হলো এরূপ যে, আমি মনে করি, ঘড়ি হাতে দেয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজগুলোর একটি।

বত্রিশ বছর পূর্বে এক অখ্যাত গ্রামের রাখাল বালকের মনের মধ্যে যে ইচ্ছা ডানা মেলেছিল তার মধ্য যৌবনে পৌঁছাতেই সে ইচ্ছার অপমৃত্যু হয়েছে। কিন্তু চশমাটা তার নিত্য সঙ্গী হয়েছে। ডাক্তার আরো ৩০ বছর পূর্বেই (হেফজ খানায় পড়া অবস্থায়ই) প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলেছে যে, ঘুম ও গোসলের সময় ব্যতীত সর্বক্ষণ চশমা চোখে রাখা বাধ্যতামূলক। সেই থেকে প্রতি বছর ১৮ জুন চোখে চশমা ব্যবহার দিবস পালন করে আসছি। ইচ্ছা না থাকলেও অনিবার্য বাস্তবতার কাছে এখানে আমাকে হার মানতে হয়েছে।

খিলগাঁও, ঢাকা,২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫

পছন্দের আরো পোস্ট