গ্রন্থাগার উন্নয়ন ও গ্রন্থাগারিকের মর্যাদা

Libraryগ্রন্থাগার হলো একটি জাতির দর্পন বা সমাজের আয়না এবং  জ্ঞানপিপাসুদের বাতিঘর। যে জাতি যত উন্নত সে জাতির গ্রন্থাগারগুলো ততোধিকই উন্নত । আধুনিক বিশ্ব সৃষ্টির শুরু থেকেই জ্ঞান আহরণের জন্য গ্রন্থাগারকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় । জ্ঞানের দ্বাররক্ষী গ্রন্থাগারিক বা তথ্য পেশাজীবী নতুন নতুন দিগন্তের  উম্মেষ ঘটান। কাঙ্খিত তথ্য সেবা ও ডিজিটাল গবেষণা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নতুন ও উদ্ভাবনশীল ধারণায় রাখেন ইতিবাচক ভূমিকা।

Post MIddle

ডঃ কুদরতে খুদা প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে হ্নদপিন্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কঠিন, নির্মম ও নিষ্ঠুর । অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারের খুবই বেহাল দশা । বইপুস্তক অপ্রতুল এবং আসবাবপত্রের অবস্থাও রুগ্ন। সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের মুখে আধুনিক গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা অহরহই  শোনা যায় । সকল প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মন্ত্রণালয় । ৬০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নেতৃত্বে দেশের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এর মধ্যে মাত্র ২১ টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গ্রন্থাগার আছে । বাকী মন্ত্রণালয়গুলোতে কোন গ্রন্থাগারই নেই । তবে কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদপ্তর ও বিভাগে আলাদা গ্রন্থাগার রয়েছে ।

প্রজাতন্ত্রের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যেককে চাকুরীতে প্রবেশের পরও অনেক পড়াশুনা করতে হয় । বিভাগীয় পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে পদোন্নতি ও যোগ্যতম স্থানে পদায়ন মেলে । একজন দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা কিংবা একজন পন্ডিত ব্যক্তি বা ভাল শিক্ষক হতে এবং সুনামের সাথে দাফতরিক কাজ পরিচালনা করার জন্যও নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হয় । এ জন্য তাঁকে নিয়মিত গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে হয়, নিতে হয় গ্রন্থাগারিকের সহযোগিতা ।

নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অফিসে প্রযুক্তি নির্ভর ও সংগ্রহে সমৃদ্ধ   গ্রন্থাগার থাকা আবশ্যক । সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে গ্রন্থাগারের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার পক্ষান্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশেই সরকারি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় পঞ্চাশ হাজারের অধিক গ্রন্থাগার । এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের এ দেশের গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগার পেশার উন্নয়ণে যথেষ্ট গাফেলতি ও উদাসীনতা রয়েছে । উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন ও উন্নতর প্রশিক্ষণের জন্য অনেক কর্মকর্তা ও শিক্ষকগণ বিদেশে যান । বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি/বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে পড়াশুনা ও পরিদর্শনের সুযোগ ঘটে । সেখানকার গ্রন্থাগারে নিয়োজিত গ্রন্থাগারিকসহ কর্মীবাহিনীর মর্যাদা সম্পর্কেও তাঁরা যথেষ্ট ধারণা পান ।

যা প্রায়শই সভা সমিতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও বিভিন্ন ফোরামে বলে থাকেন । এ দেশের গ্রন্থাগার উন্নয়ন ও গ্রন্থারিকদের পদমর্যাদার ব্যাপারে এ সকল কর্তাব্যক্তি বা নীতি নির্ধারকদের ভূমিকা রাখার কথা কিন্তু বাস্তবতা যথেষ্ঠ আশাব্যঞ্জক নয় । কার্যত: এ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়, গণগ্রন্থাগার, বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রন্থাগারসহ দু’একটি প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে নিয়োজিত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কালেভদ্রে পদোন্নতি হয়ে থাকে ।

কিন্তু ৯৫ ভাগ গ্রন্থাগারিক পদে কোনো পদোন্নতি নেই । অথচ এ পদটি প্রথম শ্রেনীর । যারা সাধারণত: সেবা দিয়ে থাকেন পন্ডিত, জ্ঞানপিপাসু, জ্ঞানোৎসাহী ও মেধাবী কর্মকর্তা/কর্মচারীকে । দেশগড়ার একজন যোগ্য কারিগর হিসেবে তৈরী করতে বইপুস্তক ও নানা রকম তথ্য সেবার সহযোগিতা করে থাকেন একজন তথ্য পেশাজীবী। গ্রন্থাগারিক / সহকারি গ্রন্থাগারিক পদে যোগ দেয়া অধিকাংশই ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বি এ/বি এস এস (সন্মান ) ও এম এ/ এম এস এস ডিগ্রীধারী । ভূক্তভোগী গ্রন্থাগারিকদের আফসোস হলো পঠিত বিষয়ের সংগে সংগতি রেখে ব্লক পদে চাকুরী করা নিয়ে।

চরম বৈষম্যের শিকার মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, সরকারি/বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রসা), সরকারি (পাবলিক) /বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, শ্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে কর্মরত  হাজার হাজার পদোন্নতি বঞ্চিত গ্রন্থাগার পেশাজীবীগণ । তারা একদিকে যেমন পদোন্নতির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত অন্যদিকে বঞ্চিত হচ্ছেন পেশাগত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও নানান সুযোগ সুবিধা থেকে । বাংলাদেশের প্রানকেন্দ্র অন্তত: ১৪টি মন্ত্রণালয়ে ১ম শ্রেণী গ্রন্থাগারিক কর্মরত রয়েছেন ।

তারা পদোন্নতির দাবিতে প্রায় এক যুগ ধরে বহুবার জনপ্রশাসন সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্ঠ পর্যায়ে একাধিকবার লিখিত আবেদন ও প্রস্তাবিত দাবিনামাসহ উপাস্থাপন ও দেখা সাক্ষাৎ করেছেন । বিনিময়ে শুধুই জুটেছে আশারবাণী । ইতোমধ্যে পুরাতন আবেদনকারীদের অনেকেই একরাশ হতাশা ও বুক ভরা কষ্ট নিয়ে অবসরে চলে গেছেন । এক সময়ের অধীনস্ত সহকর্মীরা যখন পদোন্নতি পেয়ে নিয়ন্ত্রক হন, পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্তার অধীনে সরাসরি কাজ করাটা কতটা কষ্টের, কতটা যন্ত্রণার ও লজ্জ্বার হতে পারে তা একমাত্র ভূক্তভোগীরাই অনুভব করতে পারেন ।

শুধুমাত্র একটি ইউনিফর্ম নিয়োগবিধি না থাকার অজুহাতে ব্লক পদে থেকেই যাচ্ছেন মন্ত্রণালয় / বিভাগ/ অধিদপ্তরের গ্রন্থাগারিকগণ । গ্রন্থাগারিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সামঞ্জস্য রক্ষাপূর্বক ন্যায্যতা এবং সমতার নীতি অনুসরণ করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ডি ও লেটার দিয়েছিলেন । কিছুদিন ফাইলের নাড়াচড়াও শুরু হয় । চাওয়া হয় মন্ত্রণালয়গুলোতে পদোন্নতি ও পদসৃজন সংক্রান্ত মতামত। গঠন করা হয় এ সংক্রান্ত একটি স্থায়ী কমিটি । মন্ত্রণালয়সমূহও এ ব্যাপারে ইতিবাচক মতামত দেন  । দূর্ভাগ্যবশত: তা আবার তিথিয়ে যায় । আবার শিক্ষামন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও স্কুল-মাদ্রসার গ্রন্থাগারিকদের শিক্ষকের মর্যাদা সংক্রান্ত অফিস আদেশটি কোন এক অদৃশ্য কারণে ঝুলে আছে । এ ভাবেই চলছে বাংলাদেশে গ্রন্থাগার পেশাজীবীদের জীবন ।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/অধিদপ্তরে বিভিন্ন নিয়োগ বিধিমালার আওতায় নিয়োগপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিকদের ব্লক পদ থেকে পদোন্নতির ব্যবস্থা গ্রহণ করে একটি সমন্বিত বিধিমালা প্রণয়ন করা যৌক্তিক ও সময়ের দাবি । এ ছাড়াও সরকারি/বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার পেশায় কর্মরত কর্মীদের নিয়মিত পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হলে এবং গ্রন্থাগার ও গ্রন্থাগারিকে মান উন্নয়নে কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক দৃষ্টি দিলে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায়ও এ পেশার লোকজন ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদান রাখতে সক্ষম হবেন । বিষয়টি সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক দৃষ্টিতে ভেবে দেখবেন এই প্রত্যাশা গ্রন্থাগার ও তথ্য পেশাজীবীদের ।

লেখক: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ গ্রন্থাগার সমিতি (ল্যাব)

পছন্দের আরো পোস্ট