শাবি ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের এক ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রবিবার দিবাগত রাত একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী বড়গুল এলাকার একটি মেস থেকে ওই ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নিহতের বন্ধুবান্ধব সূত্র জানায়, মৃত শিক্ষার্থীর নাম বিশ্বজিৎ মল্লিক সে বন ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় পর্বের ছাত্র। সে ক্যাম্পাসের পাশ্ববর্তী বড়গুল (টিলারগাও) এলাকায় মেসে থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আরো জানায়, মৃত বিশ্বজিত মল্লিক মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার হাসাড়া ইউনিয়নের সোনাকান্দা গ্রামের যাদব মল্লিকের ছেলে।
জালালাবাদ থানার সহকারি পরিদর্শক (এসআই) এনামুল হাসান জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে খবর পেয়ে তারা ঘটনাস্থলে এসে বিশ্বজিতের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার বলেন, বিশ্বজিতের মেসের ছেলেদের ফোন পেয়ে আমি, সহকারী প্রক্টরগন এবং জালালাবাদ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যাই। পরে দরজা ভেঙে বিশ্বজিতের ঝুলানো লাশ জালালাবাদ থানা পুলিশ উদ্ধার করে বলে জানান তিনি।
প্রাথমিকভাবে বিষয়টাকে আত্মহত্যা বলেই মনে হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি আরো জানান লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাতেই স্থানান্তর করা হয়।
বিশ্বজিতের সাথে একই রুমে থাকতেন তাপস ও রনি নামের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের দুই ছাত্র। ঘটনা সম্পর্কে তারা বলেন, দুপুর ২টার দিকে তারা রুম থেকে বের হয়ে যান। এসময় বিশ^জিত রুমেই ছিলেন। পরে বিকালের দিকে ডাকাডাকি করার পরেও সে দড়জা খোলেনি। পরে রাত দশটার দিকে আরো অনেকে এসে অনেক ধাক্কাধাক্কির পরও দরজায় কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খবর দেয়।
মেসের অন্যান্য সদস্যরা জানান, বিশ^জিত প্রায় একবছর যাবত এই মেসে থাকে। তবে তার আচরণে কখনো মনে হয় নি সে আÍহত্যা করতে পারে। অনেকটা অর্ন্তমুখী এই শিক্ষার্থী কারো সাথে খুব একটা মিশতেন না বলে জানান তারা।
বিশ্বজিতের সুইসাইড নোট নিয়ে ধোঁয়াশা: এদিকে বিশ্বজিতের সুইসাইড নোট নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তার কক্ষ থেকে উদ্ধার করা ডাইরিতে লেখা তার লেখাগুলোকে সুইসাইড নোট নয় বলে দাবি করছেন তার বন্ধুরা। কিন্তু তার ডাইরিতে লেখাগুলোর সাথে তার ব্যক্তিগত হতাশা ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সঠিক মূল্যায়ন না পাওয়ার বেদনা ফুটে উঠেছে।
বিগত জানুয়ারি মাস থেকেই তার ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো ছিলো হতাশা এবং ক্ষোভ ভরা। সেই হতাশা এবং ক্ষোভ থেকেই আÍহত্যা বলে উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এবং ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক ড. রাশেদ তালুকদার জানান, ‘লেখা পড়ে মনে হয়েছে মূলত মান অভিমান থেকেই এ কাজ হতে পারে।’
বিশ্বজিতের চাচা জোর্তিময় মল্লিক জানান, ছেলেটা আগে থেকেই একটু একা থাকতে পছন্দ করতো। এভাবে তার চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য বেশ বড় একটা ধাক্কা। এসময় তিনি মরদেহ নিয়ে মুন্সিগঞ্জ যাচ্ছেন বলেও জানান।
কি ছিলো তার সুইসাইড নোটে ?
আমাদের প্রথম বাড়ি আমাদের পরিবার, দ্বিতীয় বাড়ি আমাদের স্কুল এবং তৃতীয় বাড়ি আমার মতে বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ৪/৫ বছর একসঙ্গে থাকবেন, একটু হলেও সবার সঙ্গে মিলেমিশে সুন্দরভাবে থাকার চেষ্টা করুন। ৪/৫ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর হয়ত বা কারো সঙ্গে কখনো দেখা হবে না। শুধু শুধু ঝগড়া, হিংসা করে আপনার লাভটা কী ? সে যাবে তার পথে, আপনি যাবেন আপনার পথে। মৈত্রী তৈরি করুন, আশা করি সবাই ভালো থাকবেন।’
শনিবার নিজ কক্ষের ছাদের লোহার সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিশ্বজিৎ মল্লিক তার সুইসাইড নোটে কথাগুলো লিখে গেছেন। বিশ্বজিতের সুইসাইড নোটটি ‘প্রথম কথা’ দিয়ে শুরু হয়ে ‘পঞ্চম কথা’ পর্যন্ত লিখে তারপর ‘সর্বশেষ কথা’ বলে একটি পয়েন্টে এ কথাগুলো লেখা।
বিশ্বজিতের সুইসাইড নোটে ‘প্রথম কথায়’ একে অন্যের প্রেমিকাকে নিয়ে কটূ কথা বলার বিষয়টি দৃষ্টিপাত করে দোষ-ত্রুটি যা-ই থাক সামনাসামনি কথা বলার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। কারো পেছনে কোনো কথা না বলার জন্যও বলা হয় সেখানে।
‘দ্বিতীয় কথা’ পয়েন্টেও প্রেমিকা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে। যেখানে, যাদের প্রেমিকা আছে তারাও অপরের প্রেমিকা নিয়ে যেন মাথা ঘামায় এমন কথা বলা হয়েছে।
‘তৃতীয় কথা’ পয়েন্টে লেখা হয়েছে, বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার পর একে অপরের প্রতি বিদ্রুপ ও অশালীন মন্তব্য করার কথা, যেটা ঠিক নয় তার মতে। এ পয়েন্টে একটা প্রশ্ন করা হয়েছে। ‘তাই বলে একটু মার্জিত মন্তব্য করা উচিত নয় কি ?’
‘চতুর্থ কথা’ পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়, ‘কিছু কিছু বন্ধু আছেন যারা নিজেদের বন্ধুর ব্যপারে একটু বেশিই নাক গলান। নাকটা কম গলাবেন। অতিরিক্ত নাক গলানো তার যেমন পছন্দ নয়, তেমনি আপনারও নয় মনে রাখবেন।’
‘পঞ্চম কথা’ পয়েন্টে উল্লেখ করা হয়, ‘যেসব বন্ধু আপনাদের সঙ্গে কম মেশে তাকে নিয়ে মজা করতে আপনার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু যাকে নিয়ে মজা করছেন তার ভালো লাগে না। বরং তাকে নিয়ে মজা না করে, কেন সে আপনাদের সঙ্গে কম মিশছে বা আপনাদের সঙ্গে কয়েকদিন মেশার পর কেন এড়িয়ে যাচ্ছে তা বের তো করবেনই না, উল্টো তাকে লুথা বলবেন। সমস্যা দুই জনেরই আছে শুধু যে বন্ধুটি আপনার সঙ্গে কম মিশেছে তাকে একা দোষ দেবেন না।’
এদিকে বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে বিশ্বজিৎ মল্লিকের মরদেহ তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রবিবার মরদেহ হস্তান্তর করে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিশ্বজিতের চাচা জ্যোতির্ময় মল্লিক তার লাশ নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অফিস তালাবদ্ধ:
এদিকে, মরদেহ নিয়ে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রক্টর অফিসের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে বন ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এসময় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে বলেন, শুধুমাত্র ঘটনাস্থলে গিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মরদেহ হাসপাতালে নেয়ার সময় কোনো শিক্ষক সেখানে যাননি। পরে শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে হাসপাতালে গেলে কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।
পরবর্তীতে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার, সহকারী প্রক্টর সামিউল ইসলাম ও শাকিল ভূইয়া শিক্ষার্থীদের শান্ত করে সমস্ত অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
আশ্বাসের পর শিক্ষার্থীরা তালা খুলে দিয়ে চলে যান।
উপাচার্যের শোক
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও বনবিদ্যা বিভাগের ২য় বর্ষ ২য় পর্বের ছাত্র বিশ্বজিত মল্লিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল হক ভূইয়া।
রবিবার এক শোকবাণীতে তিনি মেধাবী এ ছাত্রের অকাল মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি নিহতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
উল্লেখ্য, শনিবার মধ্য রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী বড়গুল এলাকার ‘সুরমা নীড়’ নামক দোতলা একটি মেস থেকে বিশ্বজিত মল্লিকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে জালালাবাদ থানা পুলিশ। সে মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার সোনাকান্দা গ্রামের যাদব মল্লিকের ছেলে।#
আরএইচ