পবিত্র মেরাজ রজনি

Kubbatul-Merazসময় এবং নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। এ চিরন্তন উচ্চারণের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকে পরিচিত। নিজেরা অনেক সময় না মানলেও অন্যকে ‘সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলার’ তাগিদ দিতে কেউ কসুর করি না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা সময় ও কালের গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে বিভিন্ন আয়াত নাজিল করেছেন। শুধু আয়াতই নয়, তিনি সূরা আসর ও সূরা দাহর নামক দুইটি পৃথক সূরা নাজিল করেছেন। তাই একথা অস্বীকার করার কোনো জো নেই যে, আমরা ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় প্রত্যেকেই সময়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে আছি। সময়ের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করে কেউ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে না। বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত নবী করিম (সা.) হিজরতের দেড় হাজার বছর আগে প্রসিদ্ধ মতানুসারে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে আল্লাহর বিশেষ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছেন। দীর্ঘ এ সফর শেষে তিনি যথাসময়ে পৃথিবীতে ফিরে এলে অবিশ্বাসীরা তুরুপের তাসের মতোই একে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকে। কারণ, দীর্ঘ এ ভ্রমণ শেষ করে তিনি এলেও এসে দেখেন সামান্য সময় অতিবাহিত হয়েছে।

 

‘বোরাক’ নামের এক বিশেষ যানে করে প্রথমত মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ১ হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাসে উপস্থিত হন প্রিয়নবী (সা.)। সেখান থেকে ঊর্ধ্বালোকে গমন করে ক্রমান্বয়ে প্রথম আকাশ থেকে সপ্তম আকাশ অতিক্রম করে বায়তুল মামুরে যান। সেখান থেকে প্রাণিজগতের শেষ সীমা নির্দেশক সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন। সেখান থেকে আরও সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বেহেশত-দোজখ প্রভৃতি আল্লাহ তায়ালার অনন্ত মহিমার অতুলনীয় নিদর্শনগুলো অবলোকন করে ঐশী করুণায় প্রত্যক্ষভাবে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর একান্ত বাণী শ্রবণ করেন এবং আসমানে যেসব নবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তাদের সহকারে বায়তুল মোকাদ্দাসে ফিরে আসেন। তারা তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা জানানোর জন্য এখান পর্যন্ত আগমন করেন। এরই মধ্যে নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি নবীদের ইমাম হয়ে নামাজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর তিনি বোরাকে চড়েই রওয়ানা হন এবং অন্ধকার থাকতেই যথাস্থানে ফিরে আসেন। ফিরে এসে দেখতে পান, তাঁর অজুর পানি তখনও গড়াচ্ছে এবং বিছানা উষ্ণই ছিল। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল ভ্রমণ তথা মেরাজ সফল সমাপ্ত হয়।

 

এ মেরাজের প্রতি সব মুসলিম তথা মানুষের বিশ্বাস আছে। তবে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এত স্বল্প সময়ে এ ব্যাপক ভ্রমণ ও বহুবিধ ঘটনাবলির সংঘটন সংক্রান্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তি নিয়ে। কিছু দুর্বলমনা ঈমানদার ও অবিশ্বাসী অমুসলিমের কাছে এটা রহস্য হয়ে তাদের মনকে অনেক সময় তোলপাড় করে তোলে। তবে খাঁটি ঈমানদার বিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে এটা অত্যন্ত সহজ ছিল। কেননা তারা বিশ্বাস করে যে, হজরত (সা.) জীবনে মিথ্যা বলেননি। ‘আল আমিন’ তথা ‘মহাসত্যবাদী’ ছিল তাঁর উপাধি। তাছাড়া সব কথাই যেখানে তাঁর সত্য বলে প্রমাণিত, সেখানে মেরাজের ঘটনা অসত্য হবে কেন?

 

মহানবী (সা.) এর মেরাজের সত্যতা প্রমাণে বিজ্ঞান একটি চমৎকার তথ্য দিয়েছে। তাদের মতে, সময়ের প্রবহমান গতি মূলত পৃথিবীবাসীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আকাশ কিংবা তদূর্ধ্ব সময়ের বিষয়টা ধর্তব্য নয়। আর এ কারণেই মহানবী (সা.) এর মেরাজ সময়ের বাঁধনে ছিল না, ছিল কুদরতি এক নিয়মে আবদ্ধ। এছাড়া ঊর্ধ্বাকাশের মহাজাগতিক রশ্মি ও উল্কাপাতের মতো ভয়ংকর ও প্রাণহরণকারী বস্তু ও প্রাণীগুলোর ভয় এরই মধ্যে মানুষ জয় করতে সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে একথা দিন দিন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, মুহাম্মদ (সা.) এর এ মেরাজ বাস্তব ছিল। তাছাড়া হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্য বিংশ শতাব্দীর নভোচারীদের চেয়েও ভিন্নতর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। নিশ্চয় গ্যাসীয় বস্তুর মাঝে টিকে থাকার মতো কুদরতি ওষুধ তাঁর শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাই তো মেরাজে নেয়ার আগেই আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) নবীজিকে বক্ষবিদারণ তথা ওপেন হার্ট সার্জারি করে বেহেশতি পানি দিয়ে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে মহাকাশ উপযোগী করে নেন।

 

Post MIddle

শবেমেরাজের আমল
শবেমেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো আমলের কথা শরিয়তে উল্লেখ করা হয়নি। তারপরও এ রাতে এতদঞ্চলের ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশেষ ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতে পছন্দ করেন। বিশেষত এ রাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মসজিদ কিংবা সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রথা বহু দিন ধরে চলে আসছে। অনেকে এ উপলক্ষে নফল রোজা রাখেন। তাসবিহ-তাহলীল পাঠ করেন। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা আয়োজন না করে সাধারণভাবে এ রাতে কবরস্থানে যাওয়া এবং মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করা, দরুদ-এস্তেগফার পাঠ করে দোয়া করা। কারণ এ রাতে রাসুল (সা.) মেরাজ ভ্রমণে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শনকালে জাহান্নামিদের শাস্তি অবলোকন করেছিলেন। আমাদের দোয়া মৃত ব্যক্তিদের সেই শাস্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

 

এ রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত তথা কোরআন তেলাওয়াত করা, অধিক হারে দরুদ পাঠ করা এবং নফল নামাজ পড়া যেতে পারে। কারণ এ রাতেই মহান আল্লাহ মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে উম্মতের জন্য নামাজ ফরজ করেন। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব হবে। তাই ফরজ নামাজ ঠিক রেখে নফল নামাজ যত বেশি পড়া যায় ততই আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে ঠাঁই পাওয়া সহজ হবে। এক হাদিসে রয়েছে, ফরজের পর নফল নামাজের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমতের যত নিকটবর্তী হয়, অন্য কোনো আমলে তা সম্ভব হয় না। তাই এ রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া যেতে পারে। তবে নামাজের জন্য রাকাত সংখ্যার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; বরং সামর্থানুসারে জামাত ব্যতীত অনির্দিষ্টভাবে নফল নামাজ পড়া এবং নিজের জন্য ও সব মুসলমানের জন্য দোয়া করা উচিত।

 

শবেমেরাজের পরদিন অর্থাৎ ২৭ রজব নফল রোজা রাখা যেতে পারে। বর্ণিত আছে, রাসুলে আকরাম (সা.) যখন মেরাজ ভ্রমণে যান তখন তিনি রোজা অবস্থায় ছিলেন। তাই তাঁর স্মরণে রোজা পালন করা অবশ্যই ফজিলত হিসেবে গণ্য হবে। তবে যে কোনো নফল রোজার ক্ষেত্রে শরিয়তের বিশেষ মূলনীতি হলো, অন্তত একসঙ্গে দুইটি রোজা রাখা। রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ইহুদিরা একটি রোজা রাখে। তোমরা তাদের বিরোধিতা ও আল্লাহর অধিক সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে অন্তত দুইটি রোজা রাখ। সূত্র-আলোকিত বাংলাদেশ।

লেখক : সাবেক কলেজ শিক্ষক বেতার আলোচক

পছন্দের আরো পোস্ট