পৃথিবী হোক সাম্যের
আগে জানলে আসতাম না। জেনে ছিলাম কিনা তার স্মরণ নেই। হয়তো আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আমার অভিমত সর্ম্পকে। কিন্তু এখন যা দেখছি তা যদিও কাঙ্খিত নয়, তবুও মনে হয় এটাই চেয়েছিলাম। জগদীশ্বর যখন আমাকে পাঠালেন তখন আমি খুব কেঁদেছিলাম। এমন অবস্থায় পাঠিয়েছিলেন যে শুধু কান্না করার মত শক্তিটুকু দিয়েছিলেন। বাকিটুকু দায়দায়িত্ব ছিল এই নরকের।
স্বর্গের অধিবাসী হয়ে মর্তের নরকে আসার মাঝে আছে অভিনব খেলা। আর এ খেলায় সুদক্ষ রেফারিই সব পরিচালনা করেন। মর্তের পৃথিবীতো তিনিই অনুগ্রহ করে নিজ দক্ষতার সাথে বানিয়েছেন। এখানে তাঁর তৈরি করা যাবতীয় উপকরণ নিজ হাতে ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার ইচ্ছা অনুযায়ী সব চালাচ্ছেন।
পৃথিবীকে তিনি সৃষ্টি করলেন এবং সব কিছুই রাখলেন এর মধ্যে। যদি বলি মানুষকে এর মধ্যে দেওয়ার কী প্রয়োজন। তার উত্তর স্বয়ংক্রিয় এসে যাবে, এটিই তাঁর লীলা খেলা। খেলার মাঠে যেমন দলের ব্যবধান থাকে, তেমনি তাঁর এ খেলাতেও অদ্ভুদ ব্যবধান তৈরি করে দেন। তাঁর সমগ্র সৃষ্টি কুলের মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান দেখা যায়।
মানুষতো সৃষ্টির সেরা। এর মধ্যেও আছে নানা বর্ণ, নান জাত। সবচেয়ে বড় ব্যাবধান তৈরি করেছেন ধর্ম নামের পাহাড় দ্বারা। এক বিশ্বাসের মানুষের মধ্যেও কোন মিল নেই এবং তাদের মন মানসিকতাও এক হয়না। অথচ বিধাতা যখন এ খেলা খেলেন তখন তিনি মানুষকে সকল কিছু বোঝার মতো জ্ঞান দিয়েই পাঠান। তারপরও কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেনা।
বিধাতার এ খেলায় কেউ ধনী-বিত্তবান এমনকি রাজার ঘরে জন্ম নিচ্ছে, কেউ আবার ফকির-মিসকিনের ঘর কিংবা যাযাবরের ঘরে জন্ম নিচ্ছে। একই মানুষ বিভিন্ন ভাবে পৃথিবীতে আসছে।
ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে ২২ জুলাই ২০১৩ সালে তৃতীয় উত্তরাধিকারী হিসেবে আসলেন একজন মহা সম্মানিত ব্যক্তি। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম। তারপর এই সম্মানিত ব্যক্তির নাম রাখতে রাজ্যের সভাসদ-গুণী জনের মাথার চুল উঠে যাবার উপক্রম। যাহোক অবশেষে তার নাম ঠিক হলো ‘প্রিন্স জর্জ উইলিয়াম আলেকজান্ডার’। কতনা আদর যত্নে তিনি বড় হচ্ছেন। পাহাড় আর নদীর মতো ব্যবধানে বৈষম্যের পৃথিবীতে ¯্রষ্টা তাকে উচ্চ শীরে রাজবংশে পাঠিয়েছেন। হয়তো এই শিশুটি এটিই চেয়েছিল ¯্রষ্টার কাছ থেকে। ভবিষ্যতে তিনি হবেন রাজার ছেলে রাজা। শুধু তিনি নন, মর্তের পৃথিবীতে সুচনা লগ্ন থেকেই এমনটি চলে আসছে । শুধু ব্যবধান থেকে যাচ্ছে ধনী-গরীব, সাদা-কালো আর ভালো-মন্দতে। তাই যদি না হতো তাহলে কারো জন্ম ফুটপাতে আবার কারো জন্ম রাজপ্রাসাদে হতনা। তবুও কথাতো একটি ‘মানুষ’।
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সেরা করে তাকে সর্বোচ্চ জ্ঞান দান করেছেন। তা সত্বেও আমরা মানুষ হয়ে মানুষের জন্য একটু হায়-হুতাশ করিনা। কারণ মানুষ সবার সেরা ঠিক আছে, কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ ও অন্য মানুষের প্রতি সামান্য সহানুভুতির প্রকাশ আমাদের নেই। তার কারণ আমরা যার যার নিজ অবস্থানে থেকে শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তা করি। কিছুদিন আগে যা দেখলাম, ফুটপাতের ধারে ১০ মাস কি ১ বছরের একটি শিশু শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে। ভাবতে একটু অবাক লাগে সে কোন আশা নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সে কি আশা করেছিল। একটুকরা ছেড়া পাটি আর ছেড়া লুঙ্গির সামান্য একটি টুকরা গায়ে নিয়ে সে আসলে রোদ পোহাচ্ছেনা। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে মা হীন অসহায় অবস্থায় শুয়ে আছে। পাশ দিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ততম শহরের হর্ণ বাজানো অসংখ্য গাড়ী। তার পাশেই সরু ড্রেন। সে এমন অবস্থায়ও প্রশান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় শুধু একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পৃথিবীর নির্মম বাস্তবতা আমাকে তার কাছে যেতেও মানা করল।
এই দৃশ্যটা আমেরিকা বা ইংল্যান্ডের মতো স্বনাম ধন্য দেশের নয়। এটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার স্বাধীন দেশ বাংলাদেশের রাজধানী শহরের একটি বাস্তব চিত্র। এখানে শুধু এই দৃশ্যটার কথাই তুলে ধরলাম। অন্যান্য দৃশ্য গুলো কেমন হবে তা এমনিতেই অনুমান করার মতো। ফুটপাতের পাশ দিয়েই তো যাচ্ছিল শহরের বিত্তবান শিল্পপতিদের গাড়ী। এই মহাসম্মানিত ব্যক্তিরা তো গাড়ীর জানালা দিয়ে মুখটা বের করেন না; কারণ যদি আবার রাস্তার ধুলা, সুর্যের আলো লাগে। অথচ তারা ২০ তলা বিশিষ্ট অট্টালিকায় তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে দিন কাটাচ্ছেন। অবশ্য এদের মতো মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন লোকেরাই দেশের সম্পদ আর বাকিগুলো চুলায় দেয়া খড়কুটো। এদের দোষ দিয়েই বা লাভ কী। আমি নিজেই তো তাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছু দিতে পারিনা। এরা কোন বর্ণ বৈষাম্যর শিকার নয়, এরা মুলত সহানুভুতির শিকার।
দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের মতো ও পৃথিবীর বহু সংখ্যক শিশুরা কঠোর বাস্তবতায় বড় হয়। তারা না পায় দুবেলা খাবার-পোশাক না পায় কোন শিক্ষা। তবে এ কঠিন পৃথিবীর মাঝে এ সকল শিশুদের বাবা মায়ের আস্থার বুলি- ‘মুখ দিয়েছে যে, আহার দিবে সে।’ এ সকল মহাবাণী আর নাই গাইলাম। পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে উচুঁ-নিচু ভেদাভেদ দিয়ে। তবুও স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে এ রকম মানবতার বানী মূল্যহীন নয়।
যে যার অবস্থান থেকে তাকে স্মরণ করলেই কেবল তিনি খুশি হন। তাঁর সৃষ্টি করা এ খেলার মাঠে তাকে সবাই রেফারি হিসেবে মানুক এটাই তিনি চান। এখানে কোন সুদক্ষ লেখক বা প্রাবন্ধিকের অনুসরণ করছিনা, শুধু ব্যক্তিগত অভিমত গুলো ব্যক্ত করছি।
সকল অন্যায়-অত্যাচার, শ্রেণী- বৈষম্যের, অমানুষের মনুষ্যত্বের মর্মমূলে কুঠারাঘাত হেনে পৃথিবীতে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে মানুষই চায়। তবে বদ্ধ-উন্মাদ ও পিতৃ পরিচয় হীনদের ক্ষেত্রে একথা আলাদা। মানুষ সৃষ্টির সেরা হিসেবে তার সেরা গুণাবলী যদি না থাকে তবে বনের জন্তু আর এর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। দেশ ও জাতি বিশেষে ধর্ম সভ্যতার কথা বাদ দিলাম। কারণ ধর্ম মানুষের ওপর ঈশ্বর চাপিয়ে দেননি কিন্তু বোঝার মতো জ্ঞান দিয়েছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে ¯্রষ্টা আর সৃষ্টির মধ্যে থাকছে শুধু উপলব্ধির বিষয়। দেশ-গোত্র ও সমাজ বিশেষ পার্থক্য থাকলেও মানুষের মনুষ্যত্ব সবার ক্ষেত্রে এক হওয়া উচিৎ। বিভিন্ন ধর্মের মহামানবদের জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি ভালোবাসা ছিল উদার ও মহত্বের। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার ঐতিহাসিক ভাষণ- “আমি মরতে প্রস্তুত (I am prepared to die) শতাব্দীর শান্তি ও সৌহার্দের প্রতীক। ১৭৬ মিনিট ধরে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন- “গোটা জীবনটা আমি উৎসর্গ করেছি আফ্রিকার মানুষের মুুক্তির সংগ্রামে। আমি শেতাঙ্গদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং লড়েছি কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধেও। আমি লালন করি সেই গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন, যেখানে সবাই শান্তি ও সৌহার্দে থাকবে এবং কোন বৈষম্য থাকবে না।
এরকম অনেক মহাজ্ঞানী-মহাজন পৃথিবীকে বৈষম্যহীন করে তুলতে কঠোর সাধনা করেছেন। দিয়েছেন নিজেদের জীবন। এক্ষেত্রে আমি শুধু তাদের শ্রদ্ধা করি এরকম আরো ইতিহাসখ্যাত সংগ্রামের জন্য।
আমাদের মনুষ্যত্বকে গড়ে তোলা উচিৎ এরকম সাম্য-সৌহার্দ ও সম্প্রীতির উচ্চশীরে। কিন্তু বিভিন্ন শিশু অধিকার, নারী অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার শুধু আমাদের শ্লোগানই হয় বটে; বাস্তবে ফলপ্রসু হয় না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার, শিশু অধিকার ইত্যাদিতে আমাদেও হৈহুল্লোর বেশি। তাই আমাদের যা প্রয়োজন সেদিকে কোন খেয়াল করি না। মনুষ্যত্বের আদলে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বকে গড়তে আমি কাজ, সততা ও মনুষ্যত্বকেই স্যালুট করি। বর্তমানে এগুলো না থাকার ফলে শ্রেণী-বৈষাম্যহীন আদর্শ ও মানবতার সমাজের মুখ থুবড়ে পড়তে দেখি এবং এর অস্পষ্ট আর্তনাদটাই শুধু কানে বাজে।
পৃথিবীতে যেভাবে এসেছি সেভাবেই শূন্যহাতে পারি জমাতে হবে ওপারে। কিন্তু মর্তের পৃথিবীতে শুধু কালের ধুলোয় লেখা থাকবে সব কৃতকর্ম। ভবিষ্যতের কান্ডারিরা শুধু পর্যবেক্ষণ করবে এসকল ঘৃণিত ও প্রশংসিত কর্মকা-। তাহলে স্বার্থকতা কোথায়? বর্তমান আদর্শহীন মানবতার পৃথিবী ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কাছে কী জবাব দিবে, বা তখনকার মানবতার পৃথিবী কেমন হবে, তা আমাদের কাছে প্রশ্নের বিষয়। তখন আমাদের গড়া এ সভ্যতা আরো উদার হবে নাকি সহিংসতার বেড়াজালে জীবনের হাহাকার আরো প্রখর হবে, তাই এখন প্রশ্ন।
ফারুক খান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।