শ্রমিক-মালিক বিভাজন নেই

itজাহেলি সমাজে কোনো কোনো বৈধ পেশাকেও ঘৃণার চোখে দেখা হতো। কোনো কোনো পেশাকে আভিজাত্যের প্রতীক মনে করা হতো, আবার কোনো কোনো বৈধ ও প্রয়োজনীয় পেশাকেও ঘৃণা করা হতো। এমনকি আজকের ‘সভ্য’ সমাজও শ্রমকে ছোট করে দেখছে। অর্থের মালিককে মনে করা হয় অভিজাত মানুষ আর ‘শ্রম’ নামক সবচেয়ে বড় পুঁজির মালিককে মনে করা হয় নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। শ্রমিকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রথমেই তিনি অহেতুক বিভাজনের মূলে কুঠারাঘাত হেনে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শ্রমের প্রতি মানুষের হীন ধারণার মূলোৎপাটন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হলো, উৎপাদনে পুঁজির চেয়ে শ্রমের মূল্য আদৌ কম নয়; বরং শ্রমের প্রয়োজনই বেশি। একজন মানুষের শ্রম বিনিয়োগের সামর্থ্য থাকলে সে কিছু না কিছু তৈরি করতে পারে; কিন্তু শ্রম না থাকলে শুধু অর্থ দিয়ে কিছুই তৈরি করতে পারবে না।

 

রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যত নবীই প্রেরণ করেছেন সবাই মেষ চরিয়েছেন। সাহাবিরা বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও? নবী করিম (সা.) বলেন, হ্যাঁ, আমিও। আমি নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীর মেষ চরাতাম।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৩/৪৬৬)। শ্রমকে ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত করেছে ইসলাম। একজন শ্রমিক যখন হালাল উপার্জনের জন্য কঠোর পরিশ্রমে লিপ্ত থাকেন, তখন একদিকে তার আমলনামায় সওয়াব লেখা হয়; অন্যদিকে ঘামের সঙ্গে সঙ্গে দেহ থেকে গোনাহগুলোও বের হয়ে যায়। তার গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। একটি হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি শ্রমজনিত কারণে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যাযাপন করে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েই তার সন্ধ্যা অতিবাহিত করে।’ (তাবরানি; ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃষ্ঠা-২)।

 

Post MIddle

শ্রমিকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যথাসময়ে মজুরিপ্রাপ্তি। আমাদের আশপাশের কত চৌধুরী, খান সাহেবরা এখানে ওখানে লোক-দেখানো দানসদকা করে দানশীলতার সুনাম কুড়াচ্ছেন। অথচ তারাই হয়তো শ্রমিকের পারিশ্রমিক নিয়ে টালবাহানা করছেন; হাজারো শ্রমিকের পারিশ্রমিক কৌশলে হজম করে ফেলেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে কোরআন ও হাদিসে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর মানুষের প্রতিপক্ষ। আর আমি যার প্রতিপক্ষ তাকে পরাজিত করবই। তার মধ্যে একশ্রেণী হলো, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে অতঃপর তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে নেয়; কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করে না।’ (বোখারি : ২/৭৭৬)। শ্রমিকের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধের ব্যাপারে মহানবী (সা.) এর মতো এত দৃঢ়ভাবে বিশ্বময় আওয়াজ তোলেনি কেউ। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও।’ (ইবনে মাজাহ : ২/৮১৭)। শ্রমিকের কোনো পাওনা ভুলবশত থেকে গেলে মজুরি প্রদানের ব্যাপারে আন্তরিক হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে মিলবে পুরস্কার। হয়ে যাবে বিপদ থেকে পরিত্রাণের অসিলা। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, ‘একবার তিনজন লোক পথ চলছিল, তারা ঝড়-বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে একটি পাহাড়ের গুাহায় আশ্রয় নিল। হঠাৎ বিশাল পাথরের একটি খ- এসে পাহাড়ের গুহার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিল। তখন তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য একে অপরকে নিজেদের একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য (এখলাসের সঙ্গে) কৃত সৎ কাজের অসিলা দিয়ে দোয়া করতে বলল। তাদের ধারণা, তাহলে হয়তো আল্লাহ পাথরটি সরিয়ে দেবেন। প্রথমজন দোয়া করতে গিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ, আমার আব্বা আম্মা খুব বৃদ্ধ…। তৃতীয় ব্যক্তি বলল, ‘হে আল্লাহ, এক ফারাক চালের বিনিময়ে আমি একজনকে শ্রমিক নিযুক্ত করেছিলাম। সে তার পারিশ্রমিক না নিয়েই চলে গেল। আমি তা দিয়ে কৃষিকাজ করতে লাগলাম। আর এর দ্বারা উপার্জিত অর্থ সঞ্চয় করে রাখলাম। তা দিয়ে ছাগল, গরু কিনলাম। ছাগল ও গরু বাচ্চা দিতে দিতে অনেক বড় ছাগল ও গরুর পাল হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন পর সে আমার কাছে এলো এবং বলল, আল্লাহকে ভয় করো (আমার মজুরি দিয়ে দাও!)। আমি বললাম, ওইসব গরু ও ছাগল নিয়ে যাও। সে বলল, আল্লাহকে ভয় করো, আমার সঙ্গে ঠাট্ট করো না। আমি তো শুধু এক ফারাক চাল পাই। আমি বললাম, আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি না। (ঘটনা খুলে বলে) বললাম, ওইগুলো তোমারই। তা নিয়ে যাও! তখন সে সব ছাগল নিয়ে গেল।

 

হে আল্লাহ, আপনি জানেন, যদি আমি এ কাজটি আপনার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি, তাহলে পাথরটি আমাদের বের হওয়ার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিন। তার এ দোয়া সঙ্গে সঙ্গে কবুল হয়ে গেল এবং আল্লাহ পাথরটিকে সরিয়ে দিলেন। তিনজন লোক পাহাড়ের গুহা থেকে বের হয়ে গেল। (বোখারি : ৪/১৭২)।   সূত্র-আলোকিত বাংলাদেশ।#

 

 

আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট