অমূল্য রতন I রিমি রুম্মান

12933163_1060985530638162_4009840199993090388_nরতন এই শহরে কন্‌কনে শীতের দিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লিফলেট বিলি করে। হ্যাংলা পাতলা গড়ন। শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যাও আছে। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় হাসপাতাল, ডাক্তার এড়িয়ে চলে। হাঁপাতে হাঁপাতে একদিন আমায় লিফলেট দিচ্ছিলো। আমি ব্যাগে থাকা ইনহেইলারটি ওকে দেই। সেই থেকে মাঝে মাঝেই ওকে ইনহেইলার দিতাম। সেটা ব্যবহার করে ও ভাল বোধ করতো। এ নিয়ে তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।

 

একবার দেশে যাবার আগে কেনাকাটায় ব্যস্ত আমি। জংশন ব্লুবার্ডের মোড়ে দেখা। বলি, “রতন, দেশে যাচ্ছি, তোর মায়ের জন্য কিছু দিবি ?” রতন কাচুমাচু করে বলে, “আফা, এই দ্যশে তো সবই দাম, এরচেয়ে টাকা পাঠাইলেই বরং মা’র কাজে লাগে”। আমি বলি, সবসময় তো বলিস তোর মা কোমরের ব্যথায় কষ্ট পায়, “ব্যনগাই” নামের একটা ব্যথার মলম আছে, ওইটা দিতে পারিস”। রতন হিসাব করে। টাকা আর ডলারের হিসাব। অতঃপর বলে, “আফা, বাংলাদেশের “টাইগার বাম” আর এই দেশের “ব্যনগাই” একই জিনিষ। আমি বুঝি, রতন তাঁর কষ্টের প্রতিটি ডলারই ওর মাকে পাঠায়, এটা সেটা কিনে দেয়াকে অপচয় কিংবা বিলাসিতা মনে করে। জানালো, কিছু ডলার দিবে ওর মায়ের জন্য। আমি পরদিন যে কোন একসময় এসে নিয়ে যাবো জানিয়ে অন্য কেনাকাটায় ব্যস্ত হয়ে যাই।

 

 

পরদিন দুপুরে ওঁর বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করে ফোন দেই। রতন ওর বাসায় এক কাপ চা খেয়ে যেতে পীড়াপীড়ি করে। পুরনো এপার্টমেন্ট। যেতে যেতে বাঙালি রান্নার গন্ধ নাকে আসছিলো। কখনো শুঁটকির গন্ধ, কখনো গরুর মাংসের গন্ধ। একটি পরিবারের সাথে শেয়ারে থাকে। এক বেডরুমের বাসার লিভিং রুমে গাদাগাদি করে দু’জন আঙ্কেল আর রতন থাকে। আমায় কোথায় বসতে দিবে, কি খাওয়াবে রীতিমত হুলুস্থুল দশা। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ অতিথি আমি ! চা দিতে দিতে রতন বলে, ” আফা, জীবন একটা খড়কুটা, ভাসাইতে ভাসাইতে আমারে এইখানে নিয়া আসছে, তা-ও মন্দের ভাল, মা’রে, ভাইবোনগুলারে কিছু দিতে পারি।

 

 

ফিরে আসবার সময় রতন বালিশের নিচ থেকে একটি খাম ধরিয়ে দেয়, ওর মায়ের জন্যে। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। গলার স্বর একটু নিচুতে নামিয়ে অপরাধীর মত করে বলে, “আফা, আমি যে এইখানে এমন আছি, আমার মায়েরে কইয়েন না, তাঁরা জানে আমি অনেক ভাল আছি”। আমি পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় নিয়ে তাকাই। এই যে, পরিবারের এতগুলো মানুষের সুখের জন্যে কন্‌কনে শীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্থ উপার্জনের প্রাণান্তকর চেষ্টা, অর্থ সাশ্রয়ের জন্যে কষ্ট করে থাকা এটা কি অপরাধ !! মনেমনে বলি, তুই আসলেই তোর মায়ের অমূল্য রতন !

 

এসব বছর কয়েক আগের কথা।

 

 

Post MIddle

নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। ব্যস্ততম জংশন ব্লুবার্ডে টুকটাক কিছু কেনাকাটার উদ্দেশ্যে যাই। রতনকে আজ আর লিফলেট বিলি করতে দেখিনি। একটু এগোতেই ফলের দোকানে দেখি। বিক্রেতার সহকারী হিসেবে কাজ করছে। এগিয়ে যেতেই উৎফুল্ল কণ্ঠে জানালো দেশে ফিরে যাচ্ছে। ওর মা’ও গত হয়েছে গতবছর। আমায় বলে, ” আফা, আফনের আব্বা, আম্মারে কিছু দিবেন ? আমি পৌঁছায়া দিমু নে”। বলি, “আমার তো আব্বা, আম্মা নাই”। রতনের উৎফুল্ল মুখ নিমিষেই বিবর্ণ হয়ে যায়। ছোট্ট একটি শ্বাস নিয়ে বলে, ” ওহ্‌, আফ্‌নে তো দেহি আমার লাহান-ই, এতিম “।

 

বাড়ি ফিরছি। বাবা-মা দু’জনের মায়াময় মুখ দুটি ভেসে উঠে চোখের সামনে।
বাবার কণ্ঠস্বর কানে বাজে__ রিমি, লোক পাইলে আমার জন্য ভিটামিন ট্যাবলেট পাঠাইস।
মায়ের কণ্ঠস্বর কানে বাজে___ রিমি, লোক পাইলে ব্যথার মলম পাঠাইস……

 

গাড়ি ফরটি থ্রি এভিনিউ ধরে এগিয়ে চলছে। রাস্তার দু’ধার ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। চেরি ফুল। আমি বলি গোলাপি কৃষ্ণচূড়া। অসময়ে ভুল করে এক চিল্‌তে সোনালি রোদ মুখে এসে পড়ে। শেষ বিকেলের রোদ। বাইরে শীতল বাতাস। রেকর্ড প্লেয়ারে গান বেজে চলছে বিরামহীন

 

কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে মাতাল বাতাস…
আমি বলি, আমার দীর্ঘশ্বাস …
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস…

শুভকামনা সকলকে…

 

রিমি রুম্মান । নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র । ২৯শে এপ্রিল, ২০১৬ইং

পছন্দের আরো পোস্ট