জাতিসংঘে প্রথম নারী মহাসচিব: ইতিহাস ও কিছু রাজনৈতিক জটিলতা

Picture_Rakibul Hasanনিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব পদে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গত সোমবার দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জ়নকী তাকে এ পদে মনোনয়ন দেন। গত ৭০ বছরের নারী নেতৃত্বের শূন্যতা ঘোঁচাতে এই কিউই নারী কূটনীতিকই হয়ত বান-কি-মুনের স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন। বান কি মুন ২০১৬ সালের শেষের দিকে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করতে যাচ্ছেন।

 

নিউজিল্যান্ডের নির্বাচিত প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী (১৯৯৯-২০০৮) হেলেন ক্লার্ক। টানা তিন মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে মোট ৯ বছর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটির নেতৃত্ব দেন। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই নারী বর্তমানে ইউএনডিপি প্রধান হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদ অতিবাহিত করছেন, এখানেও রয়েছে তার টানা সাত বছরের অভিজ্ঞতা।

 

বর্তমান বিশ্ব একজন নারী মহাসচিব দেখতে প্রায় মরিয়া। কমপক্ষে ৫৩টিরও অধিক দেশ জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পদে নারী নেতৃত্বের পক্ষে তাদের সরাসরি সমর্থন ব্যক্ত করে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের ভেতর থেকেও নারী নেতৃত্বের পক্ষে জোড়ালো দাবি উঠেছে; আর এবারই প্রথম অধিক সংখ্যাক সুশীল সমাজ এ উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

 

অবশ্য ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম মনে করে (শুধু নারী বলেই নয়), মেধার ভিত্তিতেই জাতিসংঘ মহাসচিব নিয়োগ হওয়া উচিত।

 

অন্যদিকে, ক্লার্কও পরিষ্কার করে বলেন, তিনি নারী হিসেবে লড়ছেন না, বরং একটি বিচিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব, বিশ্ব নেতৃত্ব ও এর থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তার ভাষায়, “পদটি সবার জন্য উন্মুক্ত। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচিত হওয়া উচিত এবং একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমি মনে করি এ পদের জন্য যেকোনো পুরুষ প্রার্থীও সমান বিবেচনা পাবেন।”

 

এত আনুকুল্যের মধ্যেও ক্লার্কের রাস্তা কিন্তু অতটা সুগম নয়। এখন পর্যন্ত এ পদে লড়ছেন অন্য তিনজন নারীসহ মোট সাত জন হেভিওয়েট প্রতিযোগী। তিনি অষ্টমতম ও ইউরোপের বাহিরে একমাত্র প্রার্থী। বাকি নারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে রয়েছেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক বুলগেরিয়ার ইরিনা বোকভা, ক্রোয়েশিয়ার প্রাক্তন পরাষ্ট্রমন্ত্রী ভেসনা পুসিক এবং মলদোভার সাবেক পরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যাতালিয়া ঘেরম্যান। বাকি চারজন পুরুষ প্রার্থী হচ্ছেন মেসিডোনিয়ার পূর্বতন পরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্জান কেরীম, মন্টেনিগ্রোর পরাষ্ট্রমন্ত্রী আইগর লুকসিক, স্লোভেনিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি দ্যানিলো তার্ক এবং তত্কালীন পর্তুগিজ প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর হাই কমিশনার আন্তনীয় গুতারেস।

 

তিনি উল্লেখ করেন শান্তি ও নিরাপত্তা কোনো স্থির অবস্থা নয়। পরিবর্তনশীল বিশ্বে সৃষ্ট নতুন নতুন সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘের সময়োপযোগী বিবর্তন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন ক্লার্ক। ক্লার্ক তার ইশতিহারে স্পষ্ট করে বলেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বিশ্বব্যাপী গৃহযুদ্ধ ও উগ্রবাদ সৃষ্ট সঙ্ঘর্ষ মোকাবেলায়। এ ক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘের আধুনিকায়ন ও পর্যাপ্ত সংস্কারও চান।

 

Post MIddle

“নিউজিল্যান্ড বিচিত্র জাতি-গোষ্ঠী ও সংষ্কৃতির দেশ। জাতিতে জাতিতে পারস্পরিক বিভেদে দূর করে শান্তি ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন তৈরি করা আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সহজাত প্রবৃত্তিও। এই অভিজ্ঞতাগুলো বোধহয় জাতিসংঘে কাজ করার ক্ষেত্রে আমার সবচেয়ে মূল্যবান যোগ্যতা হিসেবে কাজ করবে”

 

আমার বিচারে তালিকায় হেলেন ক্লার্কই অন্য সবার চেয়ে যোগ্য প্রার্থী। কিন্তু বহুপাক্ষিক বিশ্বে সবকিছু ঠিক অতটা সহজে হয়ে উঠেনা, রাজনৈতিক দরকষাকষি পদটিকে বানিয়ে ফেলে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। নানান মহল নানান ইস্যু নিয়ে কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া মহাসচিব নিয়োগে পি-৫ রাষ্ট্রসমূহের মূখ্য ভুমিকা বিশেষ কার্যকরী; ১৫-সদস্য বিশিষ্ট জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র, ভেটো শক্তি: চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, ও যুক্তরাজ্য তাদের পছন্দসই প্রার্থী সুপারিশ করবে।

 

হুজুগ উঠেছে পূর্ব ইউরোপের ব্যাপারে। এ অঞ্চল থেকে এখন পর্যন্ত কেউ নির্বাচিত হননি। রাশিয়া বহুদিন থেকেই অভিযোগ জানিয়ে আসছে পূর্ব ইউরোপ থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব নিয়োগের জন্য। এসব সূত্রধরে অনেক বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন এবার পূর্ব ইউরোপের পালা।

 

আপনারাও হয়ত জেনে গেছেন একজন নিরপেক্ষ, প্রথাবিরোধী ও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে হেলেন ক্লার্ক যোগ্যতর প্রার্থী। তিনি কোন বিশেষ মহলের অন্ধ অনুগত নন, বিশেষভাবে পশ্চিমা মুলুকের এবং বিশ্বাস করেন জাতিসংঘ একটি বিশ্ব প্রতিষ্টান, ক্ষমতার দালালদের নয় যারা জাতিসঙ্ঘের মোড়কে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করেন।

Picture_Helen Clark

তাই সুস্পষ্ট কারণেই হয়ত পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহ এখন আর তার প্রার্থিতা সমর্থন করবে না। রাষ্ট্রপতি ওবামাও হয়ত শিগগিরই তার অবস্থান পরিস্কার করে ক্লার্কের সমর্থন থেকে সরে আসবেন। তাই যদি হয়, এর নেতিবাচক প্রভাব হালকা করে দেখার কিছুই নাই, কারণ মহাসচিব নিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশ এক্ষেত্রে অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ।

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে ক্লার্কের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে, #Helen4SG। তার মহাসচিব হওয়া বিশ্বব্যাপী নারী ক্ষময়াতনের ক্ষেত্রে বিস্তর আশা-প্রত্যাশার সঞ্চার ঘটাবে। তবে বিশ্বের ভয়াবহতম সংকটাবস্থায় ক্লার্কের ত্রিশ বছরের নেতৃত্ব কতটুক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে এখন সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুজছে সারা বিশ্ব…

 

 

লেখক একজন ওমেন ডেলিভার ফেলো, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: rhasan@wdyoungleaders.org

 

পছন্দের আরো পোস্ট