বাংলাদেশে জুওনোটিক রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে কর্মশালা

P1260631”বাংলাদেশে জুওনোটিক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও সচেতনতা বৃদ্ধি” শীর্ষক এক কর্মশালায় বক্তারা বলেছেন, মানুষের সংক্রামক রোগসমূহের মধ্যে ৬১ শতাংশ রোগ প্রাণী থেকে আসে। চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় এসব রোগ জুওনোটিক রোগ হিসেবে পরিচিত। মানুষের উদীয়মান রোগসমূহের মধ্যে ৭০ শতাংশ প্রাণী থেকে আসছে। সচেতনতার অভাবে এসব রোগ পৃথিবীব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।  শনিবার (৯ এপ্রিল)  রাজধানীর নেসেন্ট গার্ডেনিয়ার মিলানায়তনে ”রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল” আয়োজিত কর্মশালায় বক্তারা এসব তথ্য জানান।

 

P1260794রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের অঞ্চল্ভিত্তিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭১ শতাংশ মানুষ জানে না যে, প্রানী থেকে মানুষে রোগ ছড়াতে পারে। ৬৯ শতাংশ লোকের কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে কোন প্রকার ধারনাই নেই। ৩৯ শতাংশ লোক কাঁচা দুধ থেকে অসস্তিবোধ করে না এবং ১৪ শতাংশ নিয়মিত কাঁচা দুধ খায়। ৪৫ শতাংশ লোক অর্ধসিদ্ধ ডিম খায়। কাঁচা দুধ বা ডিম জুওনোটিক রোগ ছড়াতে ভূমিকা রাখে। ৫৫ শতাংশ লোক কাঁচা খেজুরের রস খায়, ৩০ শতাংশ লোক ফল ধুয়ে খায় না, ৬০ শতাংশ লোক প্রানী ছুয়ে হাত ধৌত করে না। ৭৭ শতাংশ লোক অসুস্থ প্রানী অথবা প্রানীর দুধ বা ডিম খায়। ফলে জুওনোটিক রোগ খুব সহজে প্রানী থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। উল্লেখ্য, গবেষণালব্ধ কোন পরিসংখ্যানগত তথ্য না থাকলেও সারাদেশের চিত্র এর চেয়ে ভয়াবহ বলে সহজেই অনুমেয়।

 

বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের প্রতি ১০ টি রোগের মধ্যে ৬ টি রোগই অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের সংক্রমিত হয়। ইঁদুর বাহিত রোগ প্লেগ এক সময় মহামারি আকারে দেখা দিত। তবে বর্তমানে ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, মার্স করোনা ভাইরাস, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা (বার্ড ফ্লু)-এসব জুওনোটিক রোগ বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

 

বক্তারা বলেন, জুওনোটিক রোগের মধ্যে অন্যতম রোগ হল নিপাহ্। যা বাদুরের মাধ্যমে মানুষে সংক্রামিত হয়। গবেষকরা বলেন, বাংলাদেশে ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৩১ টি জেলায় নিপাহ্ ভাইরাসে আক্রান্ত।
বাংলাদেশে জুওনোটিক রোগে সংক্রমিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে মেহেরপুর সবচেয়ে বেশি ঝুকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলে আক্রান্ত মানুষের ৮০ শতাংশই তড়কা রোগ আক্রান্ত হয়। গবাদিপশু ছাগল থেকে তড়কা রোগ মানুষের মধ্যে বেশি ছড়ায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছাগলে কম মাত্রায় টিকা দেয়ার কারণে অনাক্রম্যতা গড়ে না ওঠায় বেশি আক্রান্ত হয়। এছাড়া ফরিদপুর, রাজবাড়ী, পাবনা, সিরাজগঞ্জে গবাদি পশু-পাখি সংক্রমিত হওয়ার হার উল্লেখযোগ্য। জুওনোটিক রোগের মধ্যে এসব অঞ্চলেও বেশিরভাগ তড়কা রোগে সংক্রমিত হয়।

 

বক্তারা বলেন, জুওনোটিক রোগের মধ্যে ‘ইবোলা’ ভাইরাসকে মানুষ তুচ্ছ রোগ হিসেবে মনে করে। কিন্তু এই ভাইরাস বর্তমানে আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। ইবোলা ৭০ এর দশকে সনাক্ত করা হলেও বর্তমানে সচেতনতার অভাবে মহামারি রুপ ধারণ করেছে।
২০১২ সালের এক গবেষণায় বিশ্বের ২০ টি এলাকা জুওনোটিক রোগ ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গবেষনা না থাকায় সংক্রমনের সঠিক তথ্য নেই। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে যেসব জুওনোটিক সংক্রমন করেছে তারমধ্যে তড়কা, বার্ড ফ্লু, জলাতঙ্ক, নিপাহ্, ধনুষ্টঙ্কার উল্লেখযোগ্য।

 

রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক নজরুল ইসলামে সভাপতিত্বে কর্মশালায় বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ফুড এন্ড এগ্রিকালচার অর্গনাইজেশন (এফএও) এর ওয়ান হেলথ সমন্বয়কারী প্রফেসর নীতিশ দেবনাথ, আইইডিসিআর এর পরিচালক প্রফেসর মাহমুদুর রহমান, ড. এইচ বি এম গোলাম মাহমুদ প্রমুখ।

 

Post MIddle

P1260797প্রফেসর নীতিশ দেবনাথ বলেন, মানুষের ধারণা নিজের রোগ নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে এসব রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম দেখা যায়। ইবোলা, বার্ড ফ্লু এর মত ভয়ানক রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে গতানুগতিক ধারণার বাইরে এসে মানুষকে ভাবতে হবে। ফলে এ ক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই। নিজের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে হবে।

 

প্রফেসর মাহামুদুর রহমান বলেন, ২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে তড়কা রোগে আক্রান্ত ২৩০ জন ব্যক্তির মধ্যে ১৩০ জনই রয়েছেন মেহেরপুর জেলায়। এছাড়াও আক্রান্ত অন্যান্য জেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুষ্টিয়া, রাজশাহী অঞ্চল। মেহেরপুর ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে তড়কা রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তড়কা রোগ এমনই ভয়ানক যার জীবানু মাটিতে ১০০ বছর পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকতে পারে। বাংলাদেশের সংক্রমিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এ মহামারি রড় আকার ধারণ করবে।

 

বনাঞ্চল বা কৃষি জমি বসত ভূমিতে রূপান্তর, বনাঞ্চলের কাছাকাছি জনবসতি গড়ে ওঠা, পরিবেশের ভারসম্যহীনতা, আশ্রয় ও খাদ্যাভাবে বণ্যপ্রানীর লোকালয়ে প্রবেশ, শখের বশবর্তী হয়ে বাড়ীতে বন্যপ্রানী পালন, গোলা-বারুদ বিস্ফোরণ, বিশ্বব্যাপী মানুষের ভ্রমন বৃদ্ধিকে জুওনোটিক রোগ ছড়ায় বলে দায়ি করেছেন বিজ্ঞানীরা।

 

কর্মশালায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জুনোটিক রোগ গবেষণা ও তথ্য কেন্দ্রের কেন্দ্র ইন চার্জ ডঃ কে, বি, এম, সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মত অতি সংবেদনশীল দেশে জুনোটিক রোগের প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রন ও সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে স্থায়ী কার্যক্রম চালু থাকা দরকার। আর এর জন্য প্রয়োজন সরকারি, বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ। তিনি রিলিফ ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে এধরনের সমন্বিত কার্যক্রমে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান।

 

কর্মশালায় সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৩৪ জন বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন। ##

 

লেখাপড়া২৪.কম/এমএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট