এলিজা খাতুনের গল্প “চকমকি পাথর”

12592427_1702236426657016_7620618422828249653_nভ্যান থেকে নেমে রেনুকা কাঁধের ব্যাগ হতে পার্স বের করল। ভাড়া মিটিয়ে সতর্কভাবে ব্যাগের চেইন টানলো, টাকাগুলো এলোমেলো হয়ে আছে ব্যাগের ভেতরে। জোর পায়ে হাঁটা শুরু করল। দ্রুত বাড়ি পৌছে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে অফিসে যাবে। মেইন রোড থেকে সরু পিচের রাস্তায় নেমে মিনিট দুই হাঁটলেই ‘গড়েরকান্দা’ গ্রাম। রেনুকার বাবার বাড়ির আশেপাশেই আজ তার কিস্তি কালেকশন। ক্ষুদ্র ঋণপ্রকল্প ভিত্তিক একটা এনজিওর মাঠকর্মি সে, এনজিওটির জেলা কার্যালয় সাতক্ষীরা শহরের মধ্যে, সপ্তাহের এ দিনটাতে বাড়ির পাশে গ্রুপ কালেকশন থাকায় দুপুরে বাসায় আসতে পারে। গড়েরকান্দা গ্রামের শুরুতেই রেনুকার পৈত্রিক ভিটে। বাবা মা দুজনেই পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। আয়তাকার জমির রাস্তা সংলগ্ন সামনের দিকে ছোট ভাই এর দোতলা বাড়ি, পেছনপাশে টিনের ছাউনি দিয়ে দুটো ঘর তুলে নিয়েছে রেনুকা। তার মেয়ে অরণীকে নিয়ে দু’জনের সংশার। রেনুকা বাড়িতে ঢোকার গলিপথ মাড়িয়ে গেটের কাছে আসতেই ছোটভাই বৌ এর কন্ঠ শুনল, ছোট ভাই’কে পরামর্শ দিচ্ছে –
– ওরা আর ক’দিন থাকবে এখানে ? অরণীর বাবা শহরে নতুন বাড়ির কাজ প্রায় শেষ করল, মা মেয়ে সেখানে গিয়ে উঠলেই পারে ? পেছনের অংশ টুকু বেচে ব্যাংক এর লোন সব শোধ করতে পারবে।
ছোটভাই নিরুত্তর, রেনুকার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এল, মন শক্ত করতে হাতের মুঠো শক্ত করার ভুমিকা আছে বৈকি । বাপের ভিটেতে তারও হক আছে। অরণীর নাম ডাকতে ডাকতে সোজা ঘরে গিয়ে কাঁধের ব্যাগটা ওয়ারড্রবের ভেতরে রাখলো, সপ্তাহের এ দিনে কালেকশনের টাকার পরিমান অন্যদিনের তুলনায় বেশি। সকালে সব রান্না করে গেছে ঠিকই কিন্তু তাড়াহুড়োয় প্লেটে খাবার বেড়ে অরণীর হাতের কাছে রাখতে পারেনি। হুইল চেয়ারে মুভ করে যদিও নিজের অনেক কিছু করে নিতে পারে অরণী, তবু কদিন ধরে মেয়েটা অসুস্থ্য। অরণী নিজে নিয়ে খেয়েছে কি সকালে ? বেডের উপরে বসে কাঁথা সেলাইয়ে নিমগ্ন। রেনুকা খাবার-পাত্রের ঢাকনা সরিয়ে দেখে বুঝল অরণীর খাওয়া হয়নি। প্লেটে খাবার নিয়ে ওর সামনে রেখে বলল-
– নিজে হাতে খেয়ে নে মা, আমি গোসলে গেলাম, বেশি সময় নেই, আজ আমার ব্যাংকে যাবার কথা।
অরণী চোখ তুলে মা’কে আর খাবার প্লেট’টিকে একবার দেখে নিয়ে আবার কাঁথায় চোখ দিল,
– আব্বা পাউরুটি আর কলা এনেছিল, খেয়েছি।
– কখন ? কতক্ষণ ছিল ?
– বেশিক্ষণ না… কি সব কাগজপত্র রাখছিল।
কি এমন কাগজ রেখেছে,- একবার ভেবে এ কথায় মাথা দিতে চাইলনা রেনুকা। বাড়ি তৈরিতে টাকা পয়সার কোন হিসাবপত্র হয়ত, সময় নেই দেখার। অরণীর বাবার বাসায় আসার কিংবা একটু বেশি সময় থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই, মাঝে মাঝে নিজের কোন দরকারী জিনিস নিতে আসে, নেহাত খালি হাতে আসা খারাপ দেখায়, তাই হয়ত অরণীর জন্য কিছু একটা খাবার এনে দেয়, অরণী ওটুকুতেই তৃপ্ত। মোজাম্মেল শেখ দীর্ঘ ১১ বছর পর একেবারে চলে এসেছে বিদেশ থেকে। এ ক’বছরে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছে, কিন্তু অরণীর বাবার ফিরে আসাতে রেনুকার জীবনযাত্রায় কোন পরিবর্তন আসেনি। এখন আর গড়ের কান্দা গ্রাম ভালোলাগেনা মোজাম্মেল শেখ এর, শহরের ভেতরে একখন্ড জমি কিনে বাড়ি তৈরিতে ব্যাস্ত হয়ে গেছে। মেয়ের বয়স যখন বছর খানেক তখন বিদেশ যায়। তখনও হাঁটতে শেখেনি অরণী। পরবতী ১১ বছর বয়স অব্দি অরণী আদৌ হাঁটতে সক্ষম হয়নি, এটা বিদেশ থাকাকালীন স্বামীকে জানাতে পারেনি রেনুকা। এমন আরও অনেক দুঃসংবাদ আছে যা বিদেশে থাকা স্বামীকে জানায়নি রেনুকা। পাড়া প্রতিবেশি অনেকেই মন্তব্য করেছে- আপনজন ছেড়ে বাইরে থাকা মানুষকে দুঃসংবাদ দিতে নেই। খামখেয়ালী প্রকৃতির স্বামীর বিদেশের চাকচিক্য ছেড়ে দেশের মাটিতে ফিরে আসার আস্থা হয়ত খুবই ক্ষীণ ছিল রেনুকার মনের গহীনে, তাছাড়া একমাত্র আদরের মেয়ের জন্য মোজাম্মেল এর দেশে ফেরার যে টান সেটুকু নষ্ট করে কি লাভ ? মোজাম্মেল শেখ দেশে ফিরে এসে হুইল চেয়ারে বসে থাকা অরণীর অপুষ্ট দুটো পা এবং অস্বাভাবিক শারীরিক গঠন দেখে চমকে উঠেছিল, মেনে নিতে পারেনা আজও মেয়ের বিভৎস প্রতিবন্ধকতাকে, উপরন্তু এত বড় সংবাদ গোপন রাখার কারণে রেনুকা প্রতি আক্রোশপূর্ণ মনোভাব সর্বদা। মোজাম্মেল বহুবার রেনুকা কে বুঝিয়েছে- অরণীকে প্রতিবন্ধী আবাসন কেন্দ্রে দেবার জন্য। রেনুকা রাজি হয়না।
টিউমার এর কারণে পেটেও একটা বড় অপারেশনে রেনুকা পুনরায় সন্তান জন্ম দেবার যোগ্যতা হারিয়েছে, একথাও মোজাম্মেল দেশে ফিরে জেনেছে। রেনুকা বড় সাধ করে যদিও মেয়ের নাম রেখেছে ‘অরণী’ মানে- ‘চকমকি পাথর’, কিন্তু ওর জীর্ণ শীর্ণ অপরিণত দেহ, বিষন্ন চাহনী, মলিন মুখ খানা দেখে কে বলবে এ কথা ? তাতে কিছু যায় আসে না রেনুকার, সন্তান সে যেমনই হোক, মায়ের কাছে সন্তানের স্বাদ একই রকম। অরণীর উস্ক খুস্ক চেহারা আর অস্বাভাবিক দৈহিক গঠনে চাকচিক্যের কোন নমুনা খুঁজে পাওয়া যায়না, তবে তার ছোট্ট ছোট্ট হাতের নিপুণতায় কি অদ্ভুত সুন্দর আর চকচকে হয়ে ওঠে এক একটা নকশী কাঁথার জমিন ! রেনুকার কাছে ফোড় তোলা শিখেছিল, অসাড় দুটো পায়ের উপরে কাঁথা রেখে সারাদিনের নিরবতা কে ফোড়ে ফোড়ে গেঁথে রাখে অরণী। এই মেয়েটিকেই আতœীয়, পরিজন, প্রতিবেশির কাছ থেকে শুনতে হয়- অথর্ব, আকাম্যর পাহাড়, আরও নানা শব্দ। বড্ড স্যাঁতসেতে এই ঘর দুটোর মেঝে… বর্ষায় আদ্র থাকে, খরায় প্রচন্ড ঘামে, নিচু ছাউনির ঘরে আবছা আলোয় কাঁধ নত করে সেলাই করা খুব কষ্টের। অরণী স্বপ্ন দ্যাখে একদিন তার সব নিরবতা মুখর হয়ে উঠবে, বাবার তৈরি নতুন বাড়িতে একটা বড় ঘরের ফাঁকা মেঝে পাবে , বড় জানালার গ্রিল গলিয়ে রোদের আভা আসবে। সেখানে আরও নিখুত, পরিপাটি করে নতুন নতুন কাঁথার জন্ম দেবে। বা¯তব অভাব অনটনকে পূর্ণ করতে প্রত্যেকেই কিছু অবাস্তব কিংবা কল্পনায় ভর করে হয়ত।
¯œান শেষে রেনুকা অরণীর জন্য বাড়া ভাতের কিছু চিবিয়ে কিছু না চিবিয়ে গলাধকরন করল। ওয়াশরুমের বেসিনে কুলকুচি করতে করতে ছোট ভাই বউ এর গলা শুনল, বড় মেয়ে রুমঝুম কে চেঁচিয়ে ডাকছে তার মা-
– এদিকে আয় রুমঝুম, পরীক্ষার আগে ও মুখো যেতে বারণ করেছি না তোকে ?
– আসতিছি মা ….
– এক্ষণি আয় বলছি, এতবার নিষেধ করার পরেও কেন যাচ্ছিস ওদিকে, ঐ অপয়ার মুখ দেখে পরীক্ষা দিলে পাশ করতে পারবি হতচ্ছাড়ি ?
রেনুকা ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে অরণীর মুখের দিকে তাকালো, বুকের ভেতর একটা বিষাতুর বাতাস বয়ে গেল। অরণী মাথা নিচু করে কাঁথায় ফোড় তুলে যাচ্ছে, এসব কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে খানিকটা। রেনুকা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় অরণীর ডাক-
– মা, বের হবার সময় দরজার পাল্লা দুটো ভিড়িয়ে দিও, ওরা দু বোন পেছন বারান্দার দিকে আসলেই আমাকে দেখা যায়…
অরণী ধরেই নিয়েছে; ওর দিকে তাকিয়ে মুখ দেখা যে কারও জন্য অশুভ। নিজের প্রতি আস্থার চেয়ে অনাস্থাই ওর মনের খুব গভীরে জায়গা করে নিয়েছে। রেনুকা টের পায়- একমাত্র মা ছাড়া জগতে কারও কাছে কাঙ্খিত নয় অরণী, এমন কি তার জন্ম দাতার কাছেও নয়।
ছোট্ট অরণীকে রেখে মোজাম্মেল শেখ অনেক ঋণ করে বিদেশে চলে যায়, শশুর বাড়িতে থেকেই ঋণ শোধ দেবার নানা ঝক্কি পোহাতে হয় রেনুকাকে। অনেক প্রতিকুলতার মাঝে হাঁটতে হয়েছে তখন, চাকুরী পাওয়ার পর প্রথম প্রথম অরণীকে কোলে নিয়ে ফিল্ড এ কাজ করেছে রেনুকা। প্রথম চার বছর মোজাম্মেল কোন টাকা পাঠায়নি কিংবা পাঠালেও রেনুকার হাতে পৌঁছেনি। মেয়ে সন্তান জন্ম দেবার তথাকথিত অপরাধে শশুর বাড়ির অবমূল্যায়ন থেকে বাঁচাতে অরণীকে নিয়ে রেনুকা নিজের বাবার ভিটের এককোনে ঠাঁই করে নিয়েছে। কিভাবে সেই ক্রান্তিকাল পার হয়েছে কাওকে টের পেতে দেয়নি রেনুকা , উপলব্দি করেছে- প্রাণের অস্তিত্ব থাকা মানেই বেঁচে থাকা নয়। ধীরে ধীরে অরণীর বয়স বাড়তে থাকল, কিন্তু শরীরের নি¤œাংশ অর্থাৎ পায়ের পাতা থেকে কোমর পর্যন্ত স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি, বরং বয়স বেড়ে চলার সাথে সাথে শরীরের উপরের অংশ বিকৃতভাবে বেড়ে গেছে। রেনুকার সারা মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে থাকে। দেখতে দেখতে ১২ বছর হয়ে গেল মেয়েটার, এখন রেনুকার দুঃখ অন্য কোথাও। নিজের সংশার জীবন নিয়ে ভাবনাগুলো পেছনে সরে যাচ্ছে, আর সামনে এগিয়ে আসছে অরণীর ভবিষ্যৎ জীবন যাপনের অজানা চিত্র। সময়ের সাথে সাথে দুঃখ গুলোও পরিবর্তন হয়, দুঃখের অঙ্গপ্রত্যাঙ্গ গুলো যেন স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে ওঠে। অরণীর বেড়ে ওঠা, ওর জীবন যাপন দুঃখের মতও নয়। দুঃখকেও কোন কোন মানুষ ধারণ করতে চায় হয়ত, কিন্তু অরণীকে নয়।
মামা মামী কিংবা মামাতো ভাই-বোন অরণীকে মানুষ ভাবা তো দুরে থাক, কিঞ্চিৎ মুল্য আছে এমন অন্যকিছুও ভাবতে পারেনা। কিন্তু অরণী অনুভব করতে পারে- বাড়িতে পোষা বিড়াল, ছাগল ছানা, কিংবা হাঁসের বাচ্চা গুলোও তার চাইতে গুরুত্ব পেয়ে থাকে বোধ হয়। বিড়াল বাচ্চাটা তিনবেলা ছোট্ট মামাতো ভাই এর খাবার সঙ্গি হয়। উঠোনের রোদে মামা নিজের গায়ে সরিষার তেল মাখার সময় ছাগলের শিং-এ আর তার মাথার টিকিতে কি যতেœ তেল ঘষে দেয়। অরণী প্রায়ই বারান্দায় হুইল চেয়ারে বসে দেখে। রেনুকা কোন একটা মানবিক সাহায্য সংস্থা থেকে এটা এনেছিল। চেয়ারটায় বসেই টুকটাক হাতের কাজ করতে পারে অরণী, মায়ের অনুপস্থিতিতে কখনও কখনও মামী একবোঝা শাকের আটি দিয়ে বলে-
– পাথরের মত থোম হয়ে কি দেখিস ? এগুলো হাতে হাতে বেছে কুটে দে তো … তোর হাতেরও ব্যায়াম হবে।
অরণী কোলের উপরে মুঠো খানেক কাঁটানটে শাক নিয়ে বাছতে শুরু করে, অমনি মামাতো বোন রুমঝুম তার মাকে বলে ওঠে-
– ওমা… ওর লুলো হাতে বাছা শাক খাবা নাকি ? যদি অসুখ হয় ?
মামীর চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে, চোখ কুচকে ইশারা করে মেয়েকে, এবং উত্তর দেয়-
– আগুনে সেদ্ধ করলে সব অশুভ দুর হয়ে যায় ।
অরণী কি যেন ভাবে, নিজেকে একটু অপরাধী লাগে তার। ক্ষুদ্র শংঙ্কা উঁকি দিচ্ছে মনে, পাছে ওর হাতে বেছে নেওয়া শাক খেয়ে ওদের কিছু হয়ে যায় ! সচরাচর খাদ্যের পয়জন জনিত কারণে কিংবা পরিচ্ছন্নতার অভাবে বদহজম ঘটলে তার দ্বায় এসে পড়ে লুলা, অপয়া, অলক্ষি পরিচয়ে পরিচিত অরণীদের উপরে। ঘড় ঘড় করে গাড়ী ঠেলার শব্দে কোথায় যেন মিশে গেল অরণীর ভাবনা গুলো। ছোট মামাতো ভাই অনিক বাবু’কে কদিন আগে একটা খেলনা রিকশা গাড়ী কিনে দিয়েছে ছোট মামা। রুমঝুম পেছন থেকে ঠেলে দেয়, অনিক বাবু খিল খিল করে হাসে আর প্যাডেল ঘুরিয়ে গাড়ী ঠেলা খেলে। মামী উচ্ছসিত হয়ে বলে-
– আমার ছেলের পায়ে কত্ত জোর দেখেছিস ?
অরণীও নিথর হয়ে তাকিয়ে থাকে গাড়ী ঠেলা খেলায়, এ খেলায় কোন মজা খুঁজে পায়না। দীর্ঘ ৭ বছর ধরে একাই খেলছে গাড়ী ঠেলা খেলা। প্রথম প্রথম হাত দিয়ে চাকা ঘুরিয়ে চালাতে কষ্ট হত অরণীর। রেনুকা একটু একটু করে ঠেলে দিত আর হাত দিয়ে চাকা ঘোরানো শেখাতো। আরও কিছু শিখিয়েছে মেয়েকে, অরণীর মনের জোর টাও।
মোজাম্মেল শেখ দেশে ফেরার পর তার চালচলন, বেশভুষায় চোখে ধরার মত পরিবর্তন এসেছে। রেনুকার এখনও মনে পড়ে বিয়ের পরে সংশারে অভাব অনটন থাকায় বিবাহ বার্ষিকিতে মোজাম্মেল দামি উপহার দিতে না পারলেও, পাশের বাড়ির বেড়ার গায়ে ফোটা বেলী ফুল লুকিয়ে ছিঁড়ে এনে রেনুকার মাথায় ঘন চুলের বেনুনীতে গুঁজে দিত, বলত- দোকান মালিক এ মাসের বেতন দেয়নি গো ! রেনুকা শুভ্র তাজা বেলীফুলেই ভীষণ খুশি খাকতো। সেলস্ ম্যানের কাজ করে বেশ চলছিল ওদের সংশার। এখন প্রচুর টাকা মোজাম্মেল শেখ এর। বিশেষ কোন উপলক্ষ্য হলে দামী উপহার কিনে কারও মাধ্যমে রেনুকার কাছে পৌঁছে দিয়েই শেষ। কিন্তু অনেক দামী উপহারেও কিসের যেন অভাব থেকে যায়, সেই বেলি ফুলের দাম কোনকিছুতেই খুঁজে পায়না রেনুকা। চাকুরী জীবন, মেয়ের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, একা থাকার সংগ্রাম সব কিছু মিলে একটা বিধ্ধস্ত রং তার মুখে সারাক্ষণ ছেয়ে থাকে। উজ্জ্বলতা, কোমলতা হারিয়ে ফেলেছে কবে থেকে যেন। স্বামীর প্রতি টান, একসাথে থাকার আকাঙ্খা তবু বিরাজ করে রেনুকার মনের গহীনে। মোজাম্মেল শেখ এর সেসব ভাবার সময় কোথায়? শহরে কয়েকটা বড় দোকান কিনেছে, তাতে কর্মচারীও রেখেছে। বিদেশ যাবার পূর্বে যে দোকানে কাজ করত সেই প্রাক্তন দোকান মালিকও এখন মোজাম্মেলকে বিশেষ খাতির করে। ইদানিং রেনুকা প্রায়ই দ্যাখে প্রাক্তন দোকান মালিকের মেয়েকে বাইকে চড়িয়ে কলেজে পৌছে দেয় মোজাম্মেল, দোকান মালিকের সাথে সুসম্পর্ক থাকার সুবাদে এটুকু করতেই পারে, সন্দেহের বীজ অংকুরিত হয়না রেনুকার মনে। এনজিওর মাঠকর্মি রেনুকার রোদে পোড়া বিধ্ধস্ত ত্বকের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা কেমন আদিখ্যেতা মনে হয় মোজাম্মেল এর কাছে । দ্বায়িত্ববোধের চাপে রেনুকার ভারী হয়ে আসা কন্ঠস্বর শোনার আকুলতা আর নেই মোজাম্মেল এর। বস্তুত মন যখন অন্যকোথাও ঘুরে বেড়ায়, কান আর চোখ তখন অকেজো হয়ে দাঁড়ায় সামনের বস্তু দেখতে। রেনুকা টের পায় তার স্বামীর দেশে ফেরা মানেই ঘরে ফেরা নয়। সারাদিন ব্যাস্ততায় শহরে ঘোরা ফেরা তার, পাশের গ্রাম বাকালে মোজাম্মেল শেখ নিজেদের পুরোনো ঘরটিতে কেবল রাতটুকু ঘুমিয়ে কাটায় ।
ফাল্গুনের দিন পড়েছে, ঠান্ডা অনেকটা কমে এসেছে, ভোরে উঠে মোজাম্মেল শেখ বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। শহরে নতুন বাড়ির কাজ প্রায় কমপ্লিট, ইলেকট্রিক ওয়ারিং এর কাজ চলবে আজ। ওখানে পাশের যে কোন হোটেলে নাস্তা সেরে নেয় বেশিরভাগ দিন, আজও ডাল, পরোটা আর ডিম অর্ডার করে সামনের টেবিলের একটা জায়গা নিল। এখানের সব কটি হোটেলের কর্মচারী মোজাম্মেল কে বিদেশ ফেরত অর্থশালী ব্যাক্তি হিসেবে বাড়তি সেবা দেয় এখন। অন্যদিকে বন্ধু মহলে মোজাম্মেল কে বাড়তি সমাদর করলেও সত্যে কথার খোঁচা , তামাসা এসবে কমতি নেই, তা যতই অপ্রিয় শোনাক মোজাম্মেল এর কানে। মোজাম্মেলের সামনে নাস্তা আসার পূর্বে বন্ধু গোচের আরও দুজন এসে বসল, একজন এর ছোট্ট একটা মুদি দোকান চলে, অন্যজন অন্যের দোকানের বারান্দায় টেবিল চেয়ার পেতে বসে ফ্লাক্সি লোডের ব্যাবসা করে পেট চালায়। মোজাম্মেল হোটেল বয় কে ডেকে দু জনের নাস্তা ওয়ার্ডার করল। এই না হলে বন্ধু ! মোজাম্মেল শেখ এর দু বন্ধুর চোখ মুখ থেকে আহল্লাদ ছিটকে পড়ছে। নাস্তা এসে গেছে , চপচপ শব্দে ডাল পরোটা মুখে পুরে নিচ্ছে দুজন, মোজাম্মেল বেশ ভাব নিয়ে খাচ্ছে, নিজেকে মহান ভাবে উপস্থাপন করে বেশ তৃপ্ত । নিজেকে সেরা হিসেবে তুলে ধরার সুপ্ত প্রবণতা বেশিরভাগ মানুষেরই একটি শাশ্বত মনোভাব। খাওয়ার মাঝ পথে এক বন্ধু মোজাম্মেলকে উদ্দেশ্য করে বলল-

Post MIddle

-এত অর্থ সম্পদ কার জন্যে রাখবি রে তুই ? বন্ধুদের দিকে দেখিস দোস্ত ।
মোজাম্মেলের উদ্দেশ্যে ২য় বন্ধুর উত্তর-
– এত ভাবিস কেন ? বিপদে আপদে মোজাম্মেল ছাড়া আর কে উদ্ধার করবে আমাদের ?
– ৫০ হাজার টাকা ধার দিবি দোস্ত ? দোকানে মাল উঠাবো… আস্তে আস্তে শোধ দিয়ে দেবো ।
– আরে দেবে ছাড়া কি ? ওর আর খরচের জায়গা কই ? ওর তো ছাওয়াল নেই, বউ তো নিজের কামাই খায়, মেয়েটার বিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ।
(মোজাম্মেলের কানে অসহ্য লাগছে এসব কথা) দুজনকে বলল-
– তোরা বকবক করিস নাতো… বিরক্ত লাগছে।
টাকা ওয়ালা বন্ধুর টাকা খসানোর চতুর বুদ্ধিতে দু’বন্ধু প্রতিযোগিতা করে মোজাম্মেলকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে উঠাতে লেগে পড়েছে, এদিকে মোজাম্মেলের পরিবারের দুর্বলতার কথা তুলে গুষ্টি উদ্ধার করতেও বিন্দু মাত্র পিছপা নয় তারা। খাওয়া শেষ করে মোজাম্মেল বেসিনে গেল, সেই ফাঁকে কথার পিঠে কথা চলছে দু’বন্ধুর-
– বিয়ে কি মুখের কথা ? ওই রকম লুলা আর ঘাড় কুঁজো মেয়েকে কে নেবে ঘরে ?
– আরে বিয়ে না দিলেই কি ? যদ্দিন বাঁচবে ঘরে বসেই খাবে।
– দেখ আরেকখান বিয়ে করে ফালায় কিনা মোজাম্মেল, আগের দোকান মালিকের মেয়েকে যেভাবে বাইকে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় !
– সমস্যা কি ? সম্পত্তি সামলাতে একটা ছেলে সন্তান যদি হয়…
টেবিলের কাছে ফিরে আসতে দুজনের কথাগুলো মোজাম্মেলের কানে গেল, মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, ওয়ালেট থেকে তিনজনের নাস্তার টাকা বের করে বিরক্ত ভাবে বলল-
– তোরা খাওয়া শেষ কর… আমি গেলাম… বলে হন হন করে বেরিয়ে গেল। একজন চেঁচিয়ে বলল-
– দোস্ত সন্ধ্যায় চা এর দোকানে আসিস…
এখন অনেকেই মোজাম্মেলের অপেক্ষায় থাকে বৈকি, মোজাম্মেল যে দোকানে থাকে সেখানে অন্তত অন্যদের খাবার বাবদ খরচটা বেঁচে যায়। বাইরে বের হয়েই মোজাম্মেল রেনুকার মুঠোফোনে কল করে, রেনুকা সকালে অফিস যাবার ব্যাস্ততায় ডান হাতে কাজ করতেই থাকে আর বাঁ হাতে ফোন রিসিভ করে-
– সকাল সকাল ? কি বলবে বল …
– শুধু বলবো না… হিসেব নিকেশ আছে কিছু…
– রাতে বাসায় এসে হিসেব করো…. এখন সময় কই এসব ঝামেলা করার ?
– ঝামেলা একেবারে শেষ করার ব্যাবস্থাই করছি ।
– মানে ?
– উপরের ড্রয়ারে কিছু কাগজ রেখে এসেছি… সই করে রেখ, টাকা পয়সার হিসেবটা দেখে নিও।
– অফিস বেরুচ্ছি, পরে দেখবো।
ফোন কেটে গেল, সম্ভবত মোজাম্মেল কেটে দিয়েছে। রেনুকা ধারণা করল কিছুদিন আগে অরণীর নামে ওর বাবা কিছু টাকা ফিক্স্ট ডিপোজিট করে দিতে চেয়েছিল, হয়ত তারই কাগজ। না কি অন্য কিছু ? সারাদিন ফিল্ড ওয়ার্ক করে পুনরায় সন্ধ্যেয় অফিসে হিসেব ক্লোজ করে আটটায় ঘরে ফিরেছে রেনুকা। অরণী মাথার উপরের বাল্ব জ্বেলে বিছানায় বসে সেলাইয়ে নিমগ্ন, মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে বালিশের নিচ থেকে একখানা খাম বের করে সামনে এগিয়ে রেখে আবার ফোড় তুলে চলেছে। কাঁধের ব্যাগটা আলনার কোনায় ঝুলিয়ে রাখল রেনুকা। সিক্ত কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিল, বেসিনে যেয়ে চোখমুখে জলের ছিটা দিল। সকালেই অনেক রান্না করে গেছে, এখন রান্নার ঝামেলা নেই। মোজাম্মেলের রেখে যাওয়া কাগজগুলো দেখবে এখন। মোজাম্মেল বিদেশ থেকে ফেরার পরে এতদিন কোন হিসেব জানায়নি রেনুকাকে, তাই হয়ত ড্রয়ারে রেখে গেছে। তাহলে সই করতে বলল কিসে ? গামছায় হাত-মুখ মুছে ড্রয়ার থেকে কাগজগুলো বের করে দাঁড়িয়েই ভাঁজ খুলে দেখতে লাগল… প্রথম চোখ বুলাতেই ধাক্কা খেল, বুকের ভেতরটা আঁতকে উঠলো রেনুকার। লক লক করে বেড়ে ওঠা লাউ ডগায় এক রাশ ছাই ছেটানোর মত যেন- তার সমস্ত ভাবনায় একটা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণীর পাশে বসল, মায়ের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের অর্থ বোঝে অরণী, প্রশ্ন করল-
– ওমা, কি হয়েছে ?
রেণুকা নিরুত্তর, ড্রয়ার থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করা দেখে অরণী বোঝে এটা বাবার সেদিনের রেখে যাওয়া কাগজ।
– এটাই তো সেদিন আব্বা রেখেছে ওখানে, কিসের কাগজ মা ?
– ছাড়পত্র, আমাদের দুজনের ।
অরণী অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়।
“সই করে রেখ”… মোজাম্মেলের এ কথাটি বার বার রেনুকার কানে বেজে যাচ্ছে, অলস হাতে হেলে পড়া ডিভোর্স পেপার টি রেনুকাকে সিদ্ধান্ত নেবার পরীক্ষায় বসিয়ে রাখল নিঃশব্দে।
রেনুকা নিরব, নিচু টিনের ছাউনির নিচে ছোট্ট দুটো ঘরের সব জানালা খোলা, শীতের ভাব আর নেই, ঘরের চারপাশ অন্ধকার ঘুটঘুটে, উত্তরে ঠান্ডা হাওয়া ঘুরে গিয়ে আজ- কাল থেকে দক্ষিণের মৃদু নরম বাতাস বইছে। বেশ কিছু ক্ষণ ঘরে পিন পতন আওয়াজ নেই। জানালায় মাথা ঠেস দিয়ে রেনুকা নিশঃব্দে নিজেকে শান্ত করে যাচ্ছে, হতে পারে দক্ষিণের বাতাস নিয়ে কিংবা গভীর আতœবিশ্বাসে। রেনুকা খেয়াল করল, অরণী সেলাই থেকে চোখ তুলছেই না, আজ একটু বেশি মনোযোগী। মনে হচ্ছে আরেকটা নতুন কাঁথা হাতে নিয়েছে, চার ইঞ্চির বেশি নকশাও তুলে ফেলেছে। আজ দুপুরে বাসায় আসেনি রেনুকা। কাঁচের গ্লাস আর চিনামাটির ছোট দু টো এঁটো প্লেট দেখে বোঝা যায় কেউ এসেছিল, সকাল বেলা অরণীর জন্য আধা লিটার দুধে লাচ্চা ভিজিয়ে গিয়েছিল রেনুকা, তাই দিয়েই অরণী আগন্তুক দু’জন কে আপ্যায়ন করেছে নিশ্চয়। রেনুকা জিজ্ঞেস করতেই অরণী খাম খানা এগিয়ে ধরল-
– আগের সেলাই কাঁথা ছ’খানা নিয়ে গেল, টাকাও দিল। আর জানো মা ? ওরা বলেছে আরও বিশ খানা নেবে।
খামটি খুলে দেখলো ত্রিশ হাজার টাকা এবং একটি ভাঁজ করা কাগজ। কাগজে বিশখানা নকশিকাঁথার চাহিদা উল্লেখ করে এক লক্ষ্য টাকার অর্ডার, এবং এক বছরের চুক্তিপত্র। অরণীর অভিভাবক হিসেবে রেনুকাকে সই করতে হবে। অর্ডারের চুক্তিপত্র এবং মোজাম্মেলের রেখে যাওয়া ডিভোর্স পেপার- দুটো’তেই স্বতস্ফুর্ত ভাবে সই করলো রেনুকা। রেনুকা খুব ছোট শব্দে স্বস্তির উচ্চারণ করল- এক লক্ষ্য টাকার অর্ডার ? পাশে বসা নিশ্চল অরণীর কানে শব্দটি পৌছালো, রেনুকা দেখছে পাথরের মত নিথর দেহের অরণীর চোখ ঠিকরে সুদুর সম্ভাবনার আলোক রশ্মি যেন চক চক করে বের হয়ে আসছে। রেনুকা গভীর মমতায় স্পর্শ করছে যেন এক “জীবন্ত চকমকি পাথর” কে।

পছন্দের আরো পোস্ট