মেয়েরা মাধ্যমিকে ঝরে পড়ছে যে কারণে

image_573_81009দেশে শিক্ষায় মাধ্যমিক স্তর শেষ করার আগেই প্রায় অর্ধেক মেয়ের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যায়। নারী শিক্ষার অগ্রগতির ক্ষেত্রে এ প্রবণতাকে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সরকারি হিসেবেই ২০১৫ সালে ৪৫.৯২ শতাংশ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তর থেকে ঝরে পড়ছে।

 

দারিদ্র্যের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেই শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে রূপগঞ্জের পাখী রানীর। উত্তর কায়েত পাড়ায় ত্রিশটির মতো হিন্দু পরিবারের মধ্যে তাদের বসবাস। দিনমজুর বাবার উপার্জনে পাখী ও তার বোনের শিক্ষা খরচ বহন করা অসম্ভব।

 

পাখীর ঠাকুরমা মমতা রানী জানান, তার নাতনি পাখীকে এখন বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মমতা রানী বলেন, মানুষের কাছে হাত পেতে দুই নাতনিকে লেখাপড়া করানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করাইতে পারমু না। আবারো ভর্তি হইবো আবারো মানুষের কাছে গিয়া চাইতে পারি আমি? আমার দ্বারাতো সম্ভব না মাইনষেরে গিয়া বারে বারে বিরক্ত করবার।’

একই উপজেলার নগরপাড়ার স্কুলছাত্রী ফারজানার স্কুল বন্ধ হয়ে যায় সপ্তম শ্রেণিতে। ২০১৫ সালের মার্চে বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ আগে তার শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। বছর ঘুরতেই পুত্র সন্তানের মা হয়ে ফারজানা এসেছে বাপের বাড়িতে। ফারজানা বলেন, অভাবের কারণে সে স্কুলে উপবৃত্তির জন্য আবেদন করেছিল, কিন্তু পায়নি। ভেবেছিল বিয়ের পর হয়তো লেখাপড়া চলবে কিন্তু সেটাও আর হলো না।

ফারজানার কথায়, ‘আমারেতো বলছিল পড়াশোনা করাইবো বিয়ার পরে, কিন্তু এখন করায় না। ওনারা বলে লেখাপড়া করার দরকার নাই।’ আয়াত আলী মিয়া ও শাপিয়া বেগম তাদের ছোট মেয়ে ফারজানার মতো বড় মেয়েকেও সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন।

শাপিয়া বেগম বলেন, অভাবের সংসারে এ ছাড়া তাদের কোনো উপায় ছিল না। যদিও এখন তারা বুঝতে পারেন যে স্কুল বন্ধ করে মেয়েদের বিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি।

 

স্থানীয় একটি স্কুলে ১৬ বছর ধরে ইংরেজি পড়ান আয়েশা আক্তার। শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় আয়েশা আক্তার দেখেছেন স্কুলে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক পরিবার উদ্বিগ্ন থাকে। আর অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার ফলেও মেয়েদের স্কুল জীবন সমাপ্ত হয়ে যায়।

 

Post MIddle

আয়শা আক্তার বলেন, ‘বিয়ের জন্য যে একটা বয়সসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে কিন্তু সর্বতোভাবে এটা মানা হচ্ছে না। অভিভাবকরা বলে যে- না আমাদের মেয়েদের রাস্তায় নিরাপত্তা পাই না। সেই ক্ষেত্রে আমরা কী করবো, আমরা বিয়েটা দিয়েই দিব। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিলেই আমাদের দায়িত্বটা শেষ হয়ে যায়।’

 

বাংলাদেশে বিনামূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি আর অবৈতনিক শিক্ষার কারণে শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। আগের তুলনায় মেয়েদের ঝরে পড়ার হার কমলেও এখনো সেটি অনেক বেশি।

 

সরকারি হিসেবেই দেখা যায় ২০১৫ সালে ৪৫ ভাগের বেশি মেয়ে মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়েছে। যদিও ২০০৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৬৫ শতাংশেরও বেশি। ব্যানবেইসের ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় অষ্টম শ্রেণিতে উঠে সবচেয়ে বেশি ২১.০৭ শতাংশ স্কুলছাত্রী ঝরে পড়ে। এরপর দশম শ্রেণিতে ১৮.৫২ শতাংশ মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়।

 

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘মাধ্যমিকে এসেই আমাদের হোঁচট খেতে হয় তার বড় কারণ হলো মাধ্যমিক স্কুলের প্রায় ৯৭ ভাগ বেসরকারিভাবে পরিচালিত।’
আর্থসামাজিক অবস্থাও এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রবণতাটি এক ধরনের অশনিসংকেত। আমাদের, বিশেষ করে আমাদের সমাজের জন্য। প্রায় অর্ধেকের মতো মেয়েরা ঝরে পড়ছে, মাধ্যমিক সমাপ্ত করতে পারছে না। আর উচ্চশিক্ষার দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেটাতো একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেই।’

 

‘উচ্চশিক্ষা কেন আমিতো বলবো কারিগরি শিক্ষা যেটা অষ্টম শ্রেণির পরেই যেতে হয়, সেখানেও কিন্তু মেয়েদের অংশগ্রহণের হার প্রভাবিত করে এই ঝরে পড়ার হারটা।’ বাংলাদেশে শিক্ষায় বাজেট ঘাটতির কথা উল্লেখ করে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, মেয়েদের ঝরে পড়া বন্ধ করতে নতুনভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। ‘শিক্ষার্থী প্রতি বরাদ্দ কমে গেছে। এখন আমরা মোট বাজেটের ১০ শতাংশের একটু বেশি খরচ করি শিক্ষার জন্য, যেটা ২০০০ সালে ১৪ শতাংশের ওপরে ছিল।’

 

প্রতিবন্ধী এবং আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার বেশি উল্লেখ করে মিস চৌধুরী বলেন, ‘এখন এই ঝরে পড়া রোধ করার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা সরকারকে নিতেই হবে। যেভাবে চলছে সেভাবে হবে না। বিশেষ বরাদ্দ, বিশেষ ব্যবস্থা, বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের জন্য, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য।’

 

দেশে শিক্ষার অগ্রগতিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা করা হয়। এখন মাধ্যমিক স্তরে একটি মেয়েও যেন ঝরে পড়তে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।#

 

লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট