চবি রসায়ন বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের র্যাগ ডে উদযাপন
মার্চের ২ তারিখ সকাল নয়টা। চবির রেলস্টেশনে এক ঝাঁক তরুন তরুণীর পদচারণা। তারা সবাই রসায়ন বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রী। সবাই রসায়ন বিভাগ র্যাগ ডে লেখা সাদা টি-শার্ট পরিহিত। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর টি-শার্টে মার্কার কলম দিয়ে লিখে দিচ্ছে। আবার দেখা হবে বন্ধু, ভালো থাকিস, স্মৃতিতে থাকবি অমলিন, ছামুচা কম করে খাইস, মনে রাখিস, বিয়ের দাওয়াত দিবি কিন্তু, ঘুমের রাজা, ড্রাগোমির, যেখানেই থেকো ভাল থেকো, মিস ইউ। এরকম অনেক আবেগ জড়িত লেখা প্রত্যেকের টি-শার্টে। রেলস্টেশনে ৪৫ তম ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা একত্রিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেইট থেকে র্যালী শুরু হয়। র্যাগ ডে লেখা ব্যানার নিয়ে কাটা পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছে ছাত্রছাত্রীরা। ঢাক, ঢোল আর বাঁশি বাঁজাতে বাঁজাতে এগিয়ে চলছে ব্যান্ডপার্টি। র্যালী বিজ্ঞান অনুষদের সামনে যেতই রসায়ন বিভাগের ছোট ভাইরা দু’হাতের করতালির মাধ্যমে র্যাগের ভাইদের বরন করে নেয়।
সময় তখন সকাল ১১ টা। রসায়ন বিভাগের প্রতি ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বিজ্ঞান অনুষদ আবার র্যালী শুরু হয়। ব্যান্ডপার্টির বাদ্য, বাজনাতে, নাচতে এবং শ্লোগান দিতে থাকে ছাত্রছাত্রীরা। ৪৫ তম ব্যাচের ফটোগ্রাফার রোকন, দীপু, জয়ের ক্যামেরায় বন্দী হতে থাকে র্যাগের প্রতিটি দৃশ্য। র্যালী কলা ফ্যাকাল্টি হয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে বিবিএ ফ্যাকাল্টি তারপর শহীদ মিনারে এসে শেষ হয়। র্যালী শেষ হতেই রঙ্গের খেলা শুরু হয়ে যায়। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে, এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীকে, জুনিয়র রা সিনিয়রদের রং মাখিয়ে দিচ্ছে মুখে, মাথায়, শরীরে। রংয়ের পানিতে একেকজন ভিজে একাকার। রং ছুড়ে দিচ্ছে আকাশে বাতাসে একজন আরেকজনের দিকে। মুহুর্তেইই মধ্যেই শহীদ মিনারের পরিবেশটা যেন এক উদ্দাম হলিখেলার দৃশ্যের মত পরিণত হয়। রঙ্গের খেলা শেষ হতেই শুরু হয় ফরমালি ফটোসেশন। ব্যাচের সাথে একেএকে ফটোসেশন চলতে থাকে মাস্টার্স, চতুর্থ বর্ষ, তৃতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম বর্ষ। ফটোসেশন শেষে সবাইকে রসায়ন বিভাগে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়।
হাসি আনন্দের মাঝে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কারো তেমন কোন খেয়াল নেই। সময়গুলো কেমন যেনো দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই চেয়ারম্যান ম্যাডাম কয়েকজন সম্মানিত শিক্ষক -শিক্ষকাসহ রসায়ন বিভাগের ১২২ নাম্বার রুমে আসলেন। স্যারদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আগেই থেকেই র্যাগ ডে উপলক্ষে কেক কাটার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্যাররা কেক আর সবার টি-শার্টের অবস্থা থেকে অবাক। তিনি বলেই ফেললেন তোমরা এতকিছু কিভাবে করলে? চেয়ারম্যান ম্যাডাম সবাইকে নিয়ে কেক কেটে ছাত্রছাত্রীদের খাওয়ালেন। সুবর্ণ, মাহিদ, শাহ আলম, ফারজানা, সানজিদা, সুরাইয়া তারাও ম্যামকে কেক খাওয়ালেন। সেই সাথে কেক খাওয়ানোর মুহুর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ক্যামেরায় ফ্লাশ চলতে থাকে। কেক খাওয়া শেষে টিচারদের সাথে ফটোসেশনের পর্ব শুরু হয়।
সময় তখন দুপুর ১ টা। ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। টিচারদের সাথে নিয়ে শুরু হয় উদরপূর্তি। কেউ মুরগীর রান মুখে নিয়ে ছবি তুলছে। কেউবা মোজোর বোতল হাতে নিয়ে মডেলদের মতো পোজ দিচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই নতুন ল্যাবরেটরি ভবনের পাশে চলে আসে। দুপুর ২ টা থেকে শুরু হয় পুর্বঘোষিত ফটোসেশনের আয়োজন। কেউ সিঙ্গেল পিক, কেই ডাবল পিক, রব হলবাসি, আমানত হলবাসী, ভৌত , জৈব ও অজৈব গ্রুপ, প্রিয় বন্ধু, প্রিয় বান্ধবী, সেলফি এবং সব শেষে গ্রুপ ফটোসেশনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় ছবিতোলার পর্ব। প্রায় ঘন্টাখানিকের মতো ছবি তোলা শেষে সবাই হাঁটতে থাকে জীববিজ্ঞান অনুষদের অডিটোরিয়ামের দিকে । ওখানে আগে থেকেই কনসার্টের জন্য অডিটোরিয়াম নেওয়া হয়েছিল।
সময় তখন ৩ টা বেজে ৩০ মিনিট। অডিটোরিয়ামে দর্শক প্রায় পরিপূর্ণ। মঞ্চের ডানপাশে দাঁড়িয়ে আছে র্যাগের ব্যাচ, বামপাশে রসায়ন বিভাগের ছোটভাই এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা। মঞ্চে প্রথমেই গান গাইতে আসে ৪৫ তম র্যাগের ব্যাচের শিক্ষার্থী মাহিদের ব্যান্ড পাই বাই টু। গানে আর নাচে মঞ্চ কাপানোর পর গান গাইতে আসে ৪৫ তম ব্যাচের জনপ্রিয় শিল্পী দীপ্ত। তার গাওয়া ‘কফি হাউজ’ গানটি সবাইকে কিছুক্ষনের জন্য আবেগীময় করে তোলে এবং সবাই একইসাথে গাইতে থাকে। দীপ্তর গানের পরেই মঞ্চে আসে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী প্রসেনজিৎ। তার গাওয়া বন্ধজানালা গানটি সবাইকে আর একবার মনোমুগ্ধকর করে তোলে। অনুষ্ঠানের মাঝখানে র্যাগ ডে ব্যাচের সাথে যোগ একাত্মতা ঘোষণা করেন রসায়ন বিভাগের সম্মানিত শিক্ষক ইসমাইল স্যার। এরপর মঞ্চে একেএকে গান গাইতে আসে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ব্যান্ড মানচিত্র এবং ট্রাফিক সিগনাল। পাগলা হাওয়া, মেলায় যাইরে, দুঃখবিলাস এরকম আরও অনেক জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে মাতিয়ে রাখে পুরো অডিটোরিয়াম। গানের তালে তালে নাচতে থাকে র্যাগ ডে ব্যাচ এবং সিনিয়র জুনিয়র শিক্ষার্থীরা। কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে। কারো খেয়াল নেই। কনসার্ট প্রায় শেষের দিকে। তবুও থেমে নেই নাচ আর গান।
ট্রাফিক সিগনাল ব্যান্ডের শেষ গানটি ‘ বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষন’ গাওয়ার সাথে সাথেই এত হই হুল্লোর, হাসি আনন্দের মাঝে হঠাৎ করেই যেনো পুরো অডিটোরিয়ামে পিনপতন নীরবতা চলে আসে। সবার চোখে জল আর কান্নার রোল পড়ে যায় পুরো অডিটোরিয়ামে। একবন্ধু আরেকবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলছে আর কখনো দেখা হবে না বন্ধু। এটা মেনে নিতে পারছি না। বিদায় ! হে বন্ধু বিদায়। তোদেরকে অনেক মিস করবো। মনে রেখে দিস দোস্ত। অনেক ভালবেসেছি ফেলি তোদের। ভাল থাকিস সবাই। কথাগুলো বলতে বলতে সবার চোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। এ কান্না বন্ধুত্বের, এ কান্না ভালবাসার, এ কান্না একাকী থাকার। এ কান্না স্মৃতির। এ কান্না বিদায়ের। পুরো অডিটোরিয়ামে বিদায়ের সুর বাজতে থাকে। এ বিদায় যে কী যে বিষাদের ? কী যে কষ্টের ? এই বিদায় তা শুধু বিদায়ীরাই বুঝবে, আর কেউ না। আর কেউ বোঝার কথা নয়। বিদায়ের কথা মনে করতেই হৃদয়টা যেনো ব্যথিত হয়ে উঠছে। অজানা একটা ব্যথা নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বার বার চোখে জল আসছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে বিজ্ঞান অনুষদের ভবনে? কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে শাটল ট্রেনে? কত স্মৃতি জড়িত আছে ঝুপড়ির আড্ডায়? কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে সব বন্ধুদের সাথে? কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে শহীদ মিনারের আড্ডার সাথে? জানি সব স্মৃতিই একসময় ধূসর হয়ে যাবে। কিন্তু যে স্মৃতি বিজ্ঞান অনুষদের সাথে, যে বন্ধন জারুলতলা আর কলা ফ্যাকাল্টির ঝুপড়ি, মেরিন সায়েন্সের ঝুপড়ির সাথে, যে চলাফেরা শাটল ট্রেনের সাথে, যে ভালবাসা এই সবুজ ক্যাম্পাসের সাথে, বন্ধুর হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের। এ বন্ধন ছিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। এ স্মৃতি কখনোই মলিন হবার নয় । প্রিয় বন্ধুর মুখগুলো থেকে যাবে অমলিন। ব্যস্ততায়, জীবনের নানান ধাপে, নানান বাঁকে মুখগুলো ফিরে ফিরে আসবে বারবার।
র্যাগ ডে প্রায় শেষের দিকে। ৪৫ তম ব্যাচের সবাই ধীরেধীরে মঞ্চে ওঠে। আবেগ জড়িত গলায় কথা বলে বিদায় নেয় মাহিদ, রোকন, মুন্নী, এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থী সজল। অনেক আবেগী আর কান্নাজড়িত গলায় শেষবারের মতো মাউথ পিচ হাতে নেয় সুবর্ণ। ধন্যবাদ জানায় বিন্দু, মাসুদ, মাহিদ, শাহ আলম, ইয়ামীন, রোকন, আরিফ, ইমন, নেওয়াজ, রিংকু, সোহাগ, মাছুম, জিতু, দীপ্ত, নয়ন, জাকির, শফিক, হেলাল, ফয়সাল, শাহজাহান, সুরাইয়া, সানজিদা, সায়মা, তামান্না, মানসী, ফারজানা, মমতাজ, শান্তি, সোনিয়া সহ আরো অনেকের প্রতি। যাদের সহযোগিতা ছাড়া রসায়ন বিভাগে র্যাগ সফল হতো না। সবার প্রতি অনেক অনেক ভালবাসা এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, ভালো থাকিস, মনে রাখিস, ভালোবাসিস বলে রসায়ন বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের র্যাগ ডে’র আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষিত হয়।