বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীদের সুযোগ কতটা?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ১৫ শতাংশ কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী। পূর্ণ পরিসংখ্যান না থাকলেও, বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি বলে ধারণা করা হয়। দেশটিতে এই বিপুল পরিমাণ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই শিক্ষার সুযোগ পায়না। আর উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই সংখ্যা খুবই নগণ্য।
বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে যে কয়জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরে পৌছেছেন তাদের একজন মেহরাব হোসেন। মেহরাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। “বন্ধুদের কেউ কেউ বই বা লেকচার রেকর্ড করে দেয়, এটা শুনেই অধিকাংশ পড়াশোনা চলে।” বন্ধুর রেকর্ড করে দেয়া একটি বইয়ের অডিও শুনতে শুনতে বলছিলেন মেহরাব।
মহসিন হলে তিনিসহ ৮ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা বিভিন্ন বিভাগে পড়ালেখা করছেন। আর সব মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন প্রায় ৭২ জন প্রতিবন্ধী। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে তাদের প্রায় সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌছুনোর পেছনে এই প্রতিবন্ধীদের সবারই রয়েছে সংগ্রামের গল্প।
“আমি জানতাম না যে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা পড়াশোনা করতে পারে। কিন্তু খুব ইচ্ছে করতো পড়াশোনা করতে।” বলেন শাহানুর হক। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পড়াশোনা শেষ করে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন শাহানুর। দু’বছর বয়স থেকেই তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী । শাহানুর শৈশবে বাবা-মার সাথে ছিলেন ঢাকার কামরাঙ্গিরচরে। সাত বছর বয়সে এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে মিরপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একটি আবাসিক স্কুলের কথা জানতে পারেন। প্রতিবন্ধী সন্তানকে প্রথমে স্কুলে পাঠাতে রাজি না হলেও পরে শাহানুরের জোরাজুরিতেই তাকে স্কুলে পাঠান বাবা-মা।
মেহরাব বা শাহানুরের মতো বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের খুব কম অংশই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। সরকারী বা বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার যে সুযোগ রয়েছে তার প্রায় পুরোটাই প্রাথমিক কিংবা বড়জোর মাধ্যমিক পর্যন্ত। কিন্তু এরপর থেকে খুব শক্ত মনের জোর না থাকলে প্রতিবন্ধীদের জন্য পড়ালেখা খুবই কঠিন।
উচ্চ মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বই খুবই কম এবং শ্রুতিলিখনের জন্য তাদের যে অন্য কারো সাহায্য নিতে হয় সেটিও পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য সাংকেতিক ভাষা বোঝানোর মতো কেউ থাকে না এবং অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শারীরিক প্রতিবন্ধীদের চলাচলের উপযুক্ত নয়।
বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য দেশজুড়ে এধরণের ৭ টি সরকারী স্কুল রয়েছে। যার একটি ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে। প্রথমে ছবি এবং পরে সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হয় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের।
এই স্কুলের একজন শিক্ষিকা আমিনা আক্তার বলছেন, আগের তুলনায় এখন অনেক অভিভাবক তাদের প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের পড়ালেখার জন্য নিয়ে আসছেন। তবে তাদের আধুনিক শিক্ষা উপকরণের অভাব রয়েছে। “আমরা বোর্ডে একে হয়তো কন্টেন্টটা বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের যদি একটা প্রজেক্টরে থাকতো, তাহলে হয়তো বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে ওরা বাস্তব উপলব্ধি করতে পারতো।”বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের স্কুলটিতে ২০১৫ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর আগে স্কুলটি ছিল প্রাথমিক। ঐ স্কুলটির পাশেই রয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের একটি স্কুল। যেটিতে পড়ানো হয় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
প্রাথমিক শেষ করার পর প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য শিক্ষাজীবন বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ বাংলাদেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের অধিকাংশ স্কুলই শুধুমাত্র প্রাথমিক পর্যায়ে। মাধ্যমিকে এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে হয় মূলধারার কোন স্কুলে যার অধিকাংশতেই উপযুক্ত শিক্ষা উপকরণ নেই কিংবা স্কুলগুলো প্রতিবন্ধীদের জন্য সবসময় বন্ধুসুলভও নয়।
অনেক প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে যারা নানা কারণে মূলধারার স্কুলে শেষপর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। বেসরকারি সংগঠন, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ড. শামীম ফেরদৌস বলেন,মূলধারার স্কুলে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত করার সরকারী নির্দেশ থাকলেও মূলধারার স্কুলে পড়তে গিয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়।
“মূলধারার স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রবেশগম্যতার (চলাচলের সুবিধা) বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। অনেকসময় প্রতিবন্ধী শিশুরা সহপাঠীদের দ্বারা খারাপ আচরণের শিকার হয়। যদিও এসব সমস্যা অনেকটা কমে এসেছে, তবে যতটা প্রয়োজন ততটা কিন্তু হয়নি।
অটিস্টিক শিশু প্রাঞ্জল। মূলধারার স্কুলে ভর্তি হলেও বিরুপ পরিবেশের কারণে আবার তাকে ফিরে আসতে হয় বিশেষ স্কুলে। সে এখন পড়ছে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের কল্যানী স্কুলে । দেশজুড়ে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ স্কুল এবং সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী বিশেষ সরকারী স্কুলে পড়াশোনা করছে।
বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের স্কুলসহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে আরো অনেক প্রতিবন্ধী শিশু। এসব স্কুলের অনেকগুলো সরকার থেকে ভাতাও পেয়ে থাকে। এরপরও প্রতিবন্ধীদের খুব কম অংশকেই এখনো শিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।২০০১-০২ সালের একটি জরিপে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশে মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। এরপর আর কোন পূর্ণাঙ্গ জরিপ হয়নি।
জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের পরিচালক ড. নাফিসুর রহমান বলছেন, তারা এখন ধারণা করছেন ২০-২৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী শিশু হয়তো শিক্ষার আওতায় এসেছে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপে দেশজুড়ে প্রায় ১৫ লাখ প্রতিবন্ধীর তথ্য দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই জরিপ এখনো চলমান। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী এ সংখ্যা দেড় কোটির কম নয়।
প্রতিবন্ধী শিশুদের মধ্যে পড়ালেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রতিকূলতায় পড়তে হয় বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের। বাস্তবতা হচ্ছে, এই শিশুদের অধিকাংশই স্বাভাবিকভাবে পড়ালেখা করতে পারে না। একইভাবে অটিস্টিক শিশুদেরও একটি বড় অংশ শেষপর্যন্ত মূলধারার স্কুলে পড়ালেখা করতে পারে না।
বিগত কয়েক বছরে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে অটিস্টিক শিশুদের বিষয়ে। অটিস্টিক শিশুদের জন্য বাংলাদেশে বিশেষ স্কুল এবং সেবার ব্যবস্থাও বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধুমাত্র বিশেষ স্কুলের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তারা বলছেন, এজন্যে মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরও এবিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন।
“দেখা যায় স্কুলে যে পরিমাণ শিক্ষক থাকার কথা, তার থেকে কম শিক্ষক আছেন। তাদের আবার প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার বিষয়ে প্রশিক্ষণও নেই। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, মূলধারার স্কুলগুলো যদি প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের নিতেও চায়, অনেকসময় অন্যান্য বাচ্চাদের অভিভাবকেরাও বাঁধা দিয়ে বসেন। এখানেও সচেতনতার একটি বিশাল সমস্যা আছে।” বলেন ড. নাফিসুর রহমান।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে কাজ করে সরকারী যে সংস্থা, সেই সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে প্রতিবন্ধীদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় নিয়ে আসা। কিন্তু এজন্যে মূলধারার স্কুলগুলোকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে গড়ে তোলার জন্য যে আরো অনেক বেশি কাজ হওয়া প্রয়োজন এবিষয়েও কারো দ্বিমত নেই।##
সূত্র:বিবিসি
লেখাপড়া২৪.কম/এমএইচ