বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ৫৪ বছর

বাকৃবি / BAUকৃষি প্রধান এই দেশে প্রথম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার ঐতিহ্যবাহী জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬১ সনে ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় । মানসম্মত উচ্চতর কৃষি শিক্ষাদান এবং কৃষি উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব বহনে সমর্থ দক্ষ কৃষিবিদ, গবেষক ও প্রযুক্তিবিদ তৈরি করাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

 

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে সপ্তম সমাবর্তন। সমাবর্তনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় সেজেছে বর্ণিল সাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে সপ্তাহব্যাপী আলোকসজ্জা। সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলর মোঃ আবদুল হামিদ।সপ্তম সমাবর্তনে জুলাই-ডিসেম্বর ২০১০ সন থেকে জানুয়ারি-জুন ২০১৪ পর্যন্ত ডিগ্রিপ্রাপ্তদের মোট সংখ্যা ৪৯০৯ জন। এর মধ্যে স্নাতক ডিগ্রি প্রাপ্ত-১৯১৯ জন (ভেটেরিনারি অনুষদ-১৫৪, কৃষি অনুষদ-৭৪৩, পশুপালন অনুষদ-২২৫, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ-২০৭, কৃষি প্রকৌশল অনুষদ-১৫০, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং-৯২, মাৎসবিজ্ঞান-৩৪৮)। মাস্টার্স ডিগ্রীপ্রাপ্ত- ২৮৫১ জন এবং পিএইচ.ডি. ডিগ্রিপ্রাপ্ত- ১৩৯। এঁদের মধ্যে ১৭ জন পিএইচ.ডি. ২৫২জন মাস্টার্স এবং ৬১১জন স্নাতকসহ সর্বমোট ৮৮০ জন ডিগ্রিপ্রাপ্ত কৃষিবিদ সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করেছেন।

 

বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের আওতায় ৪৩টি শিক্ষা বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সিমেস্টার পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের মানোন্নয়ন, সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা কমিটির ওপর ন্যস্ত রয়েছে। শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ফিশারিজ কলেজ নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অধিভূক্ত কলেজ রয়েছে জামালপুর জেলার মেলান্দহ নামক স্থানে অবস্থিত।

 

এযাবত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৫,৫২৩ জন স্নাতক, ১৬,০৭৮জন এম.এসসি/এম.এস. এবং ৫৩৭ জন পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এযাবৎ ৬টি সমাবর্তনের মাধ্যমে উত্তীর্ন গ্রাজুয়েটদের ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও, বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেল লরিয়েট বিজ্ঞানী ড. নরম্যান ই. বোরলগকে সম্মানসূচক ডি.এসসি. (অনারিস কজা) ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

 

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা মোট ৬,০৭৫ জন, তারমধ্য্যে স্নাতক পর্যায়ে ৪,৪৩৪ জন, এম.এস. পর্যায়ে ১,২০৯ জন এবং পিএইচ.ডি পর্যায়ে ৪৩২ জন । অধ্যয়নরত ছাত্র ও ছাত্রীর সংখ্যা যথাক্রমে ৩৫৮৬ জন ও ২৪৮৯ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৯ জন বিদেশী শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক সংখ্যা ৫৬২, এঁদের মধ্যে ২৭০ জন প্রফেসর, ১০৭ জন সহযোগী প্রফেসর এবং ১৩৯ ও ৪৬ জন যথাক্রমে সহকারী প্রফেসর ও লেকচারার। প্রায় সকল শিক্ষকই উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যার মধ্যে ৩৬৩ জন পিএইচ.ডি. ডিগ্রিধারী।

 

কালের ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ক্রম অগ্রসরমান কর্মকান্ড পরিকল্পিতভাবে পরিচালনার জন্য এই ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো গড়ে ওঠেছে। এগুলোর মাঝে রয়েছে: দু‘টি প্রশাসন ভবন, ছয়টি অনুষদীয় ভবন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, সম্প্রসারণ ভবন, জিটিআই ভবন, ছাত্রদের জন্য নয়টি এবং ছাত্রীদের জন্য তিনটি আবাসিক হল, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্টের দ্বিতল ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ভবন, আধুনিক সুবিধা সংবলিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তন(প্রায় দুই হাজার আসনবিশিষ্ট),একটি জিমন্যাসিয়াম, স্টেডিয়াম ও স্পোর্টস কমপ্লেক্স, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কৃষি মিউজিয়াম, ফিশ মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউজ, অতিথি ভবন, ক্লাব ভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৬১১টি আবাসিক ইউনিট এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অফিস ভবনাদি। দু®প্রাপ্য গাছগাছালি সংগ্রহ করে ক্যাম্পাসের মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠেছে একটি সমৃদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেন। এই গার্ডেনের এক প্রান্তে চিরসবুজ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে ভাইস-চ্যান্সেলর মহোদয়ের সরকারি বাসভবন অবস্থিত। জাতীয় ফলের গাছগাছালি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাসে একটি দেশীয় ফলগাছের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্তম্ভ, গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয়-৭১’,বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা ঘোষণা করার স্থানটিতে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি চত্ত্বর’ নির্মিত হয়েছে।

 

Post MIddle

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পসমূহ সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ১৯৮৪ সনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সিস্টেম (বাউরেস) প্রতিষ্ঠিত হয়। বাউরেস এর তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে ১১৮৭টি গবেষণা প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং বর্তমানে এর আওতাধীন চলমান প্রকল্পসংখ্যা ২৬২টি। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ফসল ও পশু-পাখির রোগ দমন পদ্ধতি, ভ্যাকসিন, শস্যের জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কার্যক্রম দুটি প্রধান ধারায় পরিচালিত হয়ে থাকে। এর একটি ডিগ্রিভিত্তিক অপরটি প্রকল্প ভিত্তিক। মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি. পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি গবেষণা শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কোন বহিঃস্থ সংস্থার অর্থানুকূল্যে সমস্যা সমাধানমূলক প্রকল্পের গবেষণার কাজ পরিচালিত হয়।

 

কৃষি খামার, গৃহাঙ্গণ ও সমষ্টিগত উন্নয়নকল্পে পরিচালিত সম্প্রসারণ কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকদের জীবনধারার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সনে গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (জিটিআই) এবং কৃষি সম্প্রসারণ কেন্দ্র (বাউএক) গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (জিটিআই), কৃষি সম্প্রসারণ কেন্দ্র, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও অনুষদসমূহ তাদের শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কর্মকান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে আসছে। এযাবৎ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মোট ৫৭,৮৬৬ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে যার মধ্যে ২২,০১৪ জন খামারি, ৬,৭৭৯ জন মাঠকর্মী এবং ২৯,০৭৩ জন গ্র্যাজুয়েট ও পেশাজীবী রয়েছেন।

 

১৯৭১ সনের অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ হানাদারবাহিনী ও তার এদেশীয় দোসরদের সকল ষড়যন্ত্র, ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ অতিথি ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েতে উপস্থিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তাঁদের সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন।

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ(বাকসু) আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় যোগদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সবুজ চত্ত্বরে আগমণ করে যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই ঘোষণার পথ ধরেই আজ কৃষিবিদগণ চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত। কৃষি শিক্ষা ও কৃষিবিদদের যথাযথ মূল্যায়ন ও প্রথম শ্রেণীর পদমর্যাদা প্রদানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আজও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে স্লোগান হিসেবে -“বঙ্গবন্ধুর অবদান – কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান” সোচ্চার কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

 

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ এমন একটি পথিকৃৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা শিক্ষা, গবেষণা প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণের মতো বহুমাত্রিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমরা বিশ্বাস করি যথাযথ পরিকল্পনা ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে এর শিক্ষা ও গবেষণাসহ যাবতীয় কর্মকান্ডের বিকাশ অব্যাহত থাকবে এবং এর মধ্য দিয়েই কৃষি তথা জাতীয় উন্নয়নে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন আরো ফলপ্রসূ হবে Ñ এধারা অব্যাহত রাখতে আমরা প্রতিশ্রুত।

 

লেখক: সহকারী পরিচালক,জনসংযোগ ও প্রকাশনা
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

 

লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট