শিশুকে মমতার মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়ন করতে হবে

jiblu pic 20169‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করার প্রাসঙ্গিকতা হলো এই যে-চিন্তা-চেতনা মানসিকতার যোজন যোজন মাইল দূরত্ব সত্ত্বেও অনেকটা মননশীলতার গভীরে মিল খুঁজে পাই। মন ও মননশীলতার আঙ্গিক, চেতনার গভীরে অবহেলিত, প্রবঞ্চিত, অধিকারহারা মানুষের জন্য একটা গভীর মমত্ববোধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অকুতোভয় ও প্রতিবাদের প্রত্যয়বোধে উজ্জীবিত সত্তা সমাজসেবীর সঙ্গে যারা কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিমনা (যারা বিবেকবর্জিত স্তাবক, মোসাহেব নন), তারা রাজনৈতিক চেতনার আঙ্গিকের বাইরে একটা আবেগমিশ্রিত অনুভূতির জগতের অধিবাসী। তাই ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী এ গোষ্ঠীরা ক্ষমতায় পদাসিক্ত না হয়েও ইতিহাসে একদিন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন।

 

একটি দেশ কখন বড় হয়? যখন দেশটি শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যায়। একটি দেশ কখন শিক্ষায় এগিয়ে যায়? যখন সেই শিক্ষা যুগের চাহিদা মেটায়, অর্থনীতির ভিতকে শক্তিশালী করে এবং মানবিকবোধের বিকাশ ঘটায়। সেই শিক্ষা নতুন নতুন আবিষ্কার করে, প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটায় এবং তৈরি করে একটি সুদক্ষ ও সংস্কৃতিমনস্ক জনগোষ্ঠী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে কেরানি বানানোর যে শিক্ষা ছিল, তাতে আধুনীকিকরণ করার জন্য সমাজ সচেতনরা এগিয়ে এসেছিলেন।

 

তৎকালীন সময়ে পড়শুনা বড় কঠিন ছিল। আজকালের মতো ডজন ডজন পাসের হার ছিল অকল্পনীয়। মজার বিষয় হলো-বাংলা ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলায় ফেল করেছিলেন। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিএ পরীক্ষা প্রবর্তন করে। প্রথম বছর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম ও বার্মা (মিয়ানমার) থেকে ১৩ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছিলেন দুজন এবং ফেল করেছিলেন ১১ জন। টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগে যে দুজন পাস করেছিলেন, তাঁরা হলেন যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

 

বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রথমবার বিএ পরীক্ষায় ফেল করেন। তাঁর পরবর্তীকালের বিএসসি, এমএসসি, ডিএসসির কাজ ঈর্ষণীয়। বিশ শতকের উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার (আমাদের বাংলাদেশের মানুষ) কোনোরকমে বিএ পাস করে চাতরা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছিলেন। তাঁর মনে হলো, মানুষের সেবা করতে ডাক্তারি পড়া দরকার। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৮৮৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। তাঁকে লন্ডনে গিয়ে এমডি পড়ার জন্য এক অজ্ঞাত হিন্দু বিধবা অর্থসাহায্য করেছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, কুমুদশঙ্কর যক্ষ্মা হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল প্রভৃতি। তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। মৃত্যুর পর তাঁর নামে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ’। প্রথম জীবনে এন্ট্রান্স, আইএ, বিএ পরীক্ষায় তেমন ভালো ফল করেননি। কোনো পরীক্ষায় পাস করে ‘ভি’ চিহ্ন দেখানোর সৌভাগ্য স্যার নীলরতনের হয়নি। কিন্তু তাঁর মেধা ছিল, সংকল্প ছিল আর ছিল মানুষ ও জাতির কল্যাণ করার অনমনীয় স্পৃহা।

 

১৮৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাঙালির শিক্ষার মান ছিল বিশ্বমানের, নিশ্চয়ই ইউরোপের মতো নয়, কিন্তু অধিকাংশ কমনওয়েলথ দেশের চেয়ে নিচে নয়। উন্নত ছিল সেকালের কি স্কুল-কলেজের শিক্ষা, কি মাদ্রাসার শিক্ষা৷ উপমহাদেশের প্রথম শ্রেষ্ঠ মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানী মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। প্রাবন্ধিক-কথাশিল্পী আবুল ফজল এবং ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান মাদ্রাসায় পড়েছেন। কলকাতা ও ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। শুনলে অনেকে অবাক হবেন, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন হিন্দু। বহু মেধাবী ছাত্র বেরিয়েছেন আলিয়া মাদ্রাসা ও অন্যান্য মাদ্রাসা থেকে। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৯ আগষ্ট ২০১৪)

 

Post MIddle

আমেরিকার এক সময়ের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ‘সন্তানের জন্য পুক্তিমালা’ শীর্ষক কবিতায় বলেছিলেন-
আমি জানি, তাকে শিখতে হবে
সব মানুষই ন্যায়পরায়ণ নয়
সব মানুষই সত্য নয়
কিন্তু তাকে এটাও শিখাবেন
প্রতটি বদমাশের একজন নায়কও আছে
যেমন প্রতিটি র্স্বাথপর রাজনীতবিদের
একজন নিবেদিত নেতা
তাকে শিখাবেন প্রতিটি শক্রর স্থানে একজন বন্ধুও আছে।
ঈর্ষা থেকে তাকে দূরে সরিয়ে আনুন
যদি পারেন
নীরব হাসির
গোপন রহস্যটি তাকে শিখিয়ে দিন।
তাকে আগেভাগে জানিয়ে দিন
দুর্বলকে পেয়ে বসা সবচেয়ে সহজ
যদি পারেন তাকে বলে দিন
গ্রন্থের বিস্ময়…।
তাকে নির্জন সময় বের করে দিন
যাতে সে ভাবতে পারে, আকাশে পাখির রহস্য
রোদের মৌমাছি
আর সবুজ পাহাড়ের পাশে ফুল ফোটা।
তাকে শিখিয়ে দিন স্কুলে
নকল করার চেয়ে
পরীক্ষায় ফেল করা বরং সম্মানজনক
তার নিজের চিন্তাধারার ওপর
বিশ্বাস রাখার শিক্ষা তাকে দিন
এমনকি সকলেও যদি তার বিরুদ্ধে যায়
ভুল বরং তারাই
ভদ্র মানুষের সাথে তাকে
ভদ্র হতে শিখিয়ে দিন
আর কঠোর মানুষের সাথে কঠোর।

 

মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রামসুন্দর বসাক বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিশু শিক্ষা বিষয়ক পাঠ্য এখন আর শিক্ষার্থীর হাতে দেখা যায় না।
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভালভাবে চলি’,
‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল’
অথবা ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’

 

এই জাতীয় কবিতা বা ছড়া দেশের বেশিরভাগ শিশু পড়ার সুযোগই পায় না। ‘সদা সত্য কথা বলিবে’ বা ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’, ‘সৎসঙ্গে সর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ’ জাতীয় নীতিবাক্য এখন যেন হারিয়ে গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা এ সময়ে শ্লেট-পেন্সিল চেনেই না। তালপাতা এবং কঞ্চির কলম তো হারিয়ে গেছে সেই কবে। সুলেখা কালি, ফাউন্টেন পেন বা পালকের কলম এখন পঞ্চাশোর্ধ মানুষের স্মৃতির পাতায় টিকে আছে। এখন শুরুতেই শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় ঝকঝকে বই, ডায়েরী, খাতা-কলম, আর্ট পেন্সিল, স্কুল ড্রেস, দামী ব্যাগ, ওয়াটার পট আরও কত কি! এভাবে শিক্ষার সঙ্গে অর্থের একটি যোগসূত্র গড়ে উঠেছে সর্বক্ষেত্রে।

 

বিভূতি ভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র শিশু অপু নিশ্চিন্তপুর গ্রামের প্রসন্ন গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় কিভাবে শিক্ষা গ্রহণ করত তার বিবরণ অনেকেরই কম বেশি জানা। সত্যজিৎ রায় রূপালী পর্দায় বন্দী করে তা আমাদের দেখিয়েছেন। মুদি দোকানের পাশে খোলা ঘরে মাটিতে মাদুর পেতে শিক্ষার্থীরা বসত। প্রসন্ন গুরু মহাশয় দোকানের খদ্দের বিদায়ের পর গ্রামবাসীর সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কাছ থেকে পড়া আদায়ে ছিলেন কঠোর। গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের পটভূমিকায় লেখা এই উপন্যাসে যেভাবে প্রসন্ন গুরু মহাশয়ের পাঠশালার বর্ণনা আছে, তা থেকে বোঝা যায় দেশে শিক্ষার ‘শৈশব’ কেমন ছিল। পাশাপাশি এ প্রশ্নটিও আপনা আপনি আসে-সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা, বৈদেশিক সাহায্য, শিক্ষা খাতে সর্বাধিক বরাদ্দের ধারাবাহিকতা প্রভৃতি সত্ত্বেও আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা কতখানি এগিয়েছে! প্রসন্ন গুরু মহাশয়দের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে অপুরা কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার মৌলিক ভিত ছিল ঐসব পাঠশালা। আর এখন প্রাইমারী স্কুলে একাধিক শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ নিয়েও একজন শিক্ষার্থী নিজের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। jiblu78.rahman@gmail.com

 

 

লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট