বইপড়া সংস্কৃতি
বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রে’ আজকের দিনের রুচিশীল নাগরিকদের ভারি সুন্দর একটা পরিচয় আছে। তাদের গৃহসজ্জার বর্ণনা দিয়ে বাৎস্যায়ন লিখেছেন, শোয়ার ঘরে পরিচ্ছন্ন চাদরে ঢাকা পালঙ্কের ওপর একটা বিছানা থাকবে, আলনাতে একখানা জায়নামাজ ও তসবি। টেবিলের ওপর পবিত্র কোরআন শরিফ। পাশে গন্ধদ্রব্য আর থাকবে বই। শোয়ার ঘরে বই থাকার অর্থ সে বই গৃহসজ্জার জন্য নয়, পড়ার জন্য। এ বই সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিশিষ্ট কোনো ক্লাসিক গ্রন্থই শোয়ার ঘরে মাথার কাছে থাকবে। বাৎস্যায়নের এ বর্ণনাটি রুচিশীল নাগরিকের। দীর্ঘদিন বিদেশি শাসনে বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে আমাদের এ অঞ্চলে এমন রুচিশীলতা বিস্মৃত হয়েছে। আমাদের বাঙালি ঘরে সুন্দর করে সাজানো ফুলদানিতে ফুল রাখা এমন গৃহসজ্জা কবি লেখকরাই আমাদের বিশেষভাবে শিখিয়েছেন। বইপড়া যে শিক্ষিত মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য সে বিষয়ে দেশ-বিদেশে কারোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। একালেই অনেক বড় লোকের বাড়িতে মেহগনি তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখাকে অনেকে কটাক্ষ করেন কিন্তু বাড়িতে বই রাখা যদি ফ্যাশন হয় তবে সেই ফ্যাশনকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেব। আজকের পৃথিবীতে একথা সবাই জেনে গেছে, যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি তত বেশি শিক্ষিত সংস্কৃতিবান। এ কথা তো জানা, কাব্যচর্চা এক নির্মল আনন্দ। বৃহত্তরভাবে বলা যায়, সাহিত্যচর্চা না করলে সে আনন্দ থেকে মানুষ বঞ্চিত থাকে। তার ভেতরকার সুকুমার বৃত্তিগুলো বিকশিত হতে পারে না। মানবিকতার প্রতি টান রুদ্ধ হয়ে যায়। একটা প্রায় বর্বর হয়ে পড়ে।
বইপড়ার জন্য পৃথিবীর সব দেশেই লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায় যেমন লাইব্রেরি থাকে তেমনি ব্রিটিশ মিউজিয়াম বা আমাদের ন্যাশনাল লাইব্রেরি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগার কিংবা এশিয়াটিক সোসাইটির মতো বৃহৎ লাইব্রেরি এবং গবেষণাগার সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা আধুনিক সভ্য সমাজে একটা বিশাল দফতর হয়ে উঠেছে। ব্যক্তিগতভাবে বই কিনে নিজের মতো লাইব্রেরি গড়ে তোলা অনেকেরই শখ। এ লাইব্রেরিকে অধ্যাপক আবুল ফজল বলেছেন, ‘মনের হাসপাতাল’। তিনি আরও বলেছেন, এর স্থান স্কুলের অনেক ওপরে। এ কথা সহজে জানা, পাস হওয়া মানে শিক্ষিত হওয়া নয়। আর সুশিক্ষিত মানেই স্বশিক্ষিত। মনকে সতেজ রাখে সাহিত্য পাঠ, স্বাভাবিকভাবেই নতুন প্রজন্মকে গ্রন্থাগারমুখী করে তোলা দেশের সুস্থ নাগরিকদের একটি সামাজিক কর্তব্য। আমরা একালে বড়রা এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারি না বলেই আমাদের বংশধররা ক্রমান্বয়ে গ্রন্থবিমুখ হয়ে উঠেছে। অনেকে বলবেন, এজন্য টেলিভিশনের একটা নিরর্থক ভূমিকা আছে। কথাটা পুরো সত্য নয়। শিশুকে শৈশব থেকে গ্রন্থমুখী করে তুললে কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাধ্য নেই যে তাকে গ্রন্থবিমুখ করে তোলে। ইউরোপে দেখেছি দুই-তিন বছর বয়সের শিশু নার্সারি স্কুলে যায়। সেখানে খেলার ছলে বর্ণ পরিচয় ও শব্দভা-ার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় রঙ আর তুলি। ইচ্ছেমতো তারা রঙ আর তুলি নিয়ে চুবিয়ে চুবিয়ে তার কল্পনার বর্ণময় রূপগুলো কাগজে তুলে ধরতে থাকে। সপ্তাহে দুইদিন তাদের একটা করে বই বাড়িতে আনতে দেয়া হয়। এভাবে বুক শেলফ থেকে বই নিতে নিতে এমন একটা অভ্যাস তৈরি হয় যে, আগে নেয়া কোনো বই শিশু কখনও বাড়ি নিয়ে যায় না। যে শিশুর বর্ণ পরিচয় হয়নি সে বই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কী করবে। একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু ভাবলেই বোঝা যাবে সপ্তাহে দুইবার করে বাড়িতে বই নিয়ে যাওয়া একটা অভ্যাস তৈরি করে দেয়। শিশু বাড়িতে ছবি দেয়া গল্পের বইগুলো মা-বাবাকে দিয়ে পড়িয়ে গল্পরস আস্বাদন করে থাকে। পড়তে শিখলে আগ্রহে নিজেই বই পড়তে থাকে। এ পঠন অভ্যাস দ্বারাই একটি জাতি তৈরি হয় ধীরে ধীরে।
আমাদের শৈশব-কৈশোর বয়সে বই পড়া নিয়ে আমরা যেসব কা- করতাম সে কথা জানলে একালের অভিভাবকরা আর্তনাদ করবেন। আমরা জ্যামিতির বইয়ের তলায় বই লুকিয়ে চিৎকার করে জ্যামিতি মুখস্থ করার ছলে বইটি শেষ করার চেষ্টা করতাম, কারণ পরের দিন সকালে সে বই ফেরত দিতে হবে। আমাদের কলেজ জীবনে প্রথম ক্লাসেই জিজ্ঞেস করা হতো আমরা সে সময় কী বই পড়েছিলাম? কেউ বলত রাজসিংহ, কেউ গোরা, কোনো ছেলে যখন বলে উঠতে সে ‘উদ্ধারণপুরের ঘাট’ পড়ছে তখন খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠতেন অধ্যাপক। আমরা এখন যখন ছেলেমেয়েদের অনার্স ক্লাসে কী বই পড়ছে জিজ্ঞেস করি তখন প্রায় সবাই ফ্যালফ্যাল করে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। জানা যায়, সে সময় নষ্ট হবে ভেবে জীবনে একটা গল্পের বইও পড়েনি। এ দোষটা ছাত্রছাত্রীদের নয়, সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকদের কিছুটা বাবা-মায়ের। আমরা তাদের শৈশব থেকে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করে দিইনি।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উল্টোভাবে চলে। ইংরেজরা এ অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছে ৬৫ বছর হলো; কিন্তু ক্রমান্বয়ে ইংরেজিআনা আমাদের চেপে ধরেছে। এখন তো ইংরেজি না শিখলে উচ্চ সমাজে মেলামেশা করা যায় না। ঔপনিবেশিক শিক্ষার একবারের খারাপ একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের জাতি চলছে এখনও। এর মধ্যেই কি বিপুল উদ্দীপনায় গ্রামে, গঞ্জে, শহরে প্রচুর গ্রন্থমেলা হচ্ছে। শহরে আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় ছোটখাটো স্টলে যে পাঠকরা আসেন তারা সাহিত্যে নিবেদিত পাঠক- দূর গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসেন তারা। কিন্তু পাশের ছোট-বড় ইংরেজি বইয়ের স্টলগুলোতে ভিড় করে যে উজ্জ্বল তরুণ-তরুণীরা তারা আমাদের বাঙালি ঘরের ছেলেমেয়ে অথচ ভাষা হিসেবে বরণ করে নিয়েছে ইংরেজি ভাষাকে। দেশের উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা যদি এভাবে বাংলা সাহিত্যের বাইরে চলে যায় তাহলে একটা জাতির সাহিত্য বেড়ে ওঠা ভবিষ্যতে খুবই কষ্টকর, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। শিশুর বই কেনার একটা ধুম চলে এসব মেলায়; কিন্তু মা-বাবারা কেনেন নানা কমিক্স আর ছবিতে গল্পজাতীয় কাহিনীর চিত্রিত বই। শিশুর কল্পনা শক্তি বাড়ে রূপকথা অ্যাডভেঞ্চারের ভ্রমণজাতীয় বইয়ে। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, এ জাতীয় বইয়ে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে তাদের আগ্রহ তৈরি করে দেয়া। তার ফল হবে, ধীরে ধীরে তারা সাহিত্য পাঠ করে এমন এক আনন্দের সঙ্কেত পেয়ে যাবে যে কখনোই আর বই না পড়ে থাকতে পারবে না।
প্রয়োজনের তাগিদে ইংরেজি ভাষা শেখা দোষের কিছু নয়; কিন্তু ইংরেজি শেখার অর্থ নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা বা বর্জন করা নয়। নিজের ভাষার প্রতি যার ভালোবাসা নেই তাকে কখনোই ভালো নাগরিক বলা যায় না। ভাষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় নিজের মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসা। আজ যে আমাদের দেশের উজ্জ্বল ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়তে গিয়ে, চাকরি করতে গিয়ে আর দেশে ফিরতে চায় না সে তো শুধু অর্থের লোভ নয়- দেশের প্রতি ভালোবাসার কোনো টান থাকে না বলেই এমনটা হতে পারে। আশ্চর্য এই যে, দেশে বাবা-মা পড়ে রয়েছে সেই মাতৃভূমির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা এই ভালো ছেলেমেয়ের দল কখনোই অনুভব করে না। সাহিত্য যে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করে, তা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলেই এমনতর ঘটনা আজ ঘরে ঘরে ঘটে যাচ্ছে। বইপড়াকে যদি শখ হিসেবেও দেখা হয় তবে বলতে হবে, সেটা মনুষ্য জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ। বই পড়ে ইহলৌকিক নানা জাতীয় লাভের আশা করা দুরাশা এমনকি বই পড়লেই মানুষ নীতিবাদী হয়ে একটা সমাজকে রক্ষা করবে- এমনও নয়; কিন্তু বই পড়া থেকে যে সংস্কৃতি তৈরি হয় সেটা মানুষকে রুচিবান করে তোলে। এ রুচিশীলতা মানবজীবনের অন্যতম কৃত্য। এ রুচির অভাবের জন্যই আমরা এত অসহিষ্ণু হয়ে পথে-ঘাটে, পার্লামেন্টে যে কা- করি তা শুধু হাস্যকরই নয়, রুচিহীন বলেই তা একটা জাতির জীবনে গভীর সঙ্কট সৃষ্টি করে। বই পড়ায় অভ্যস্ত হলে একজন মানুষ যে আনন্দের আস্বাদ পাবে তা তার মনকে শুধু সজীব করে রাখবে তা নয়, ভালোবাসতে শেখাবে প্রকৃতিকে, মানুষকে, তার নিজের কল্পনা শক্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। ফলে জগৎ নিয়ে, জীবনকে নিয়ে নতুন সৃষ্টিময় জগৎ তৈরি করতে উৎসাহিত হবে সেই পাঠক। এভাবে একটা জাতির জীবনে বই পড়া সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠলে সেই জাতি শুধু সহনশীল-রুচিশীল হয়ে উঠবে তা-ই নয়, পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে বহুল পরিমাণে সাহায্য করবে।
বই পড়া জ্ঞানচর্চার সহায়ক, বিশ্বজগতের নানা আবিষ্কার, মানুষের উদ্ভব ও ক্রমবিবর্তনের রোমাঞ্চকর কাহিনী যে কোনো পাঠককে মানব প্রজাতি সম্পর্কে আগ্রহী করে তার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনে তাকে তুলবে রুচিশীল এক বিশিষ্ট নাগরিকরূপে। এভাবে বইপড়া শুধু একজন পাঠককে জ্ঞানী বা প্রাজ্ঞ করে তুলবে না, তাকে সাহিত্য পাঠের আনন্দ এমন এক জগতের সঙ্গে পরিচিত করবে, যে জগৎটি সারা বিশ্বের রুচিশীল মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
একজন রুচিশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সামাজিক দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের মধ্যে বইপড়ার আকর্ষণ তৈরির সব সুযোগ সৃষ্টি করে রাখা। এটা শুধু মুখের ভাষাতে হবে না, নিজেদের তা করে দেখাতে হবে। আর তখনই আমরা আমাদের একটা সুস্থ-সবল জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে পারব। (সূত্র-আলোকিত বাংলাদেশ)।
আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট