মেট্টোরেলের রুট বদলের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি

IMG_6388মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) দুপুর  একটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি উপস্থাপন করা হয়। খোলা চিঠিটি উপস্থাপন করেন বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের ছাত্রী তাইশা তাশরিন। উপস্থাপন শেষে চলমান আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

 

শিক্ষার্থী জানান, আগামী ২০ জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০টায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে রোড পেইন্টিং, এবং একই দিন দুপুর ১১টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্র-শিক্ষক-নাগরিকদের নিয়ে সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এই সমাবেশ থেকে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
নিম্নে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে খোলা চিঠিটি উপস্থাপন করা চিঠিটি তুলে ধরা হল:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের রুট নির্মাণের প্রতিবাদে আমাদের আন্দোলনের বিষয়টি আপনি নিশ্চিতভাবেই জানেন এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে আপনি ইতোমধ্যে বক্তব্যও প্রদান করেছেন। আমাদের দাবি এবং আপনার বক্তব্য— এ দুটি বিষয়ে চোখ রাখলে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, আমাদের বক্তব্য আপনার কাছে খ­িত আকারে পৌঁছেছে। আমাদের আন্দোলনের সামগ্রিক দিক কোনোভাবেই রাষ্ট্রের চলমান উন্নয়নের বিপক্ষে নয়, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উন্নয়নটি আরও টেকসই হওয়া প্রয়োজন। রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও যানজট নিরসনে মেট্রোরেল স্থাপন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু এই যুগান্তকারী পদক্ষেপটি বাস্তবায়নে যদি আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারকচিহ্নগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা বাস্তবায়িত হলেও প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।

 

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আবারও আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের উন্নয়নবিরোধি আন্দোলন নয়; বরং উন্নয়নকে সকল প্রশ্নের উর্ধ্বে রেখে বাস্তবায়নে সহযোগিতা করাই আমাদের লক্ষ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আমাদের মতো আপনারও ক্যাম্পাস। ১৯৭৩ সালে আপনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। এই ক্যাম্পাসের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ওতোপ্রতো স¤॥^ন্ধ আপনার অজানা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কেবলই শিক্ষার তীর্থকেন্দ্র নয়, বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও সূতিকাগার। এই ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতা ৯৪ বছরের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানটি তার শিক্ষা ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রম, অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্থাপত্যশৈলীর মধ্য দিয়ে অব্যাহত রাখছে। বাংলাদেশের যে কোনো জাতীয় উত্সবে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সকল মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সুতরাং রাষ্ট্রের উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত যৌক্তিকভাবেই গর্বের, অহঙ্কারের। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই আন্দোলন কেনো? এর সরল উত্তর হলো— যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলনের বীজ রোপন থেকে মহীরূহ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যায় বাংলার মানুষ, বিকল্প ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সে-ই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত, স্থাপত্যশৈলী, শিক্ষা ও সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে উন্নয়নটি বিবেচনাপ্রসূত নয় বলেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা মনে করি, আমাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতার নানা দিক খ­িত আকারে আপনার কাছে পৌঁছেছে, সে লক্ষ্যেই এই খোলা চিঠি।

 

মেট্রোরেল প্রকল্পের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে ও ইআইএ রিপোর্টের সুপারিশ

মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেটি করেছিলো অঊঈখ নামক একটি প্রতিষ্ঠান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এইচ হক- এর নেতৃত্বে এই সার্ভে হয়েছিলো। গবেষণায় কাজ করেছিলেন মোট ১২ জন গবেষক। গত বছরের (২০১৫) মাঝামাঝিতে এই হিস্টোরিকাল ইমপরট্যান্স বা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের খসড়া রিপোর্ট পেশ করেছিলেন গবেষক দল। তাঁরা উপসংহারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই সার্ভেতে ঢাকা শহরের বুদ্ধিজীবী, স্থপতি, ঐতিহাসিক, প্রতœতাত্ত্বিকদের ইন্টারভিউ নিয়েছেন এবং তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল রেকর্ড, প্রতœতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক মূল্য বিবেচনায় টিএসসি-দোয়েল চত্বর দিয়ে রুট না নিয়ে শাহবাগ মত্স ভবন দিয়ে নেয়া হোক। উল্লিখিত রিপোর্টে সংসদ ভবনকেও বাঁচানোর সুপারিশ ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে রুট না নেবার কথাগুলো রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা ছিলো।

 

বক্তব্যটি প্রকল্পেরই নিজস্ব আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে বলা হয়েছে, উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এমন কি পয়েন্ট টু পয়েন্ট স্থাপনা ধরে বলা হয়েছে মেট্রোরেলের কারণে এগুলি ঝুঁকিপূর্ণ। এটা নিয়ে ২০১৫ সালের মে মাসে পত্র-পত্রিকায় রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে। আাির্কওলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রকল্পটি বাস্তাবায়িত হলে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।

 

Post MIddle

মেট্রোরেলের জন্য প্রকল্পের যে অফিশিয়াল  রিপোর্ট আছে খোদ সেখান থেকে উপরের ছবিটি নেয়া হয়েছে। এই ছবিতেই যে বিন্দুগুলো দেখা যাচ্ছে সেটা হলো রুটের আশেপাশের আর্কিওলজিক্যাল স্থাপনা। এখানে লক্ষ্যণীয়, পুরো রুট জুড়ে গুটিকয়েক বিন্দু। আর শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবশিষ্ট সব বিন্দু বা ঐতিহাসিক স্থাপনা বা পুরাকীর্তিগুলো। মোট বিন্দুগুলির ৯০ শতাংশই চারুকলা, টিএসসি ও দোয়েল চত্বরকেন্দ্রিক।

স্থাপনা ও স্থাপত্যশৈলী

মেট্রোরেলটি আক্ষরিক অর্থে শাহাবাগ-টিএসসি-দোয়েল চত্বরের মাঝখান দিয়ে যাবে। প্রকল্পের অফিশিয়াল ইউটিউব ভিডিও  ও ইআইএ রিপোর্টেও উল্লেখ আছে যে, এটি সড়কের মাঝ বরাবর যাবে। প্রকল্পে উল্লেখ আছে মোট ১৬টি স্টেশন হবে। প্রতিটি স্টেশনের দৈর্ঘ্য ১৮০ মিটার ও প্রস্থ ২০-২৬ মিটার। টিএসসি সংলগ্ন রাস্তার মাঝ দিয়ে যাওয়া রুটেও থাকছে এরকম একটি স্টেশন। এই রুটে পাশাপাশি দুটি ট্রেন চলতে পারবে। নিচের ছবি দুটিতে দোয়েল চত্বর এবং টিএসসি সংলগ্ন মেট্রোরেলের অবস্থান দেখানো হলো।

 

সুস্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, ঐতিহাসিক মোঘল স্থাপনা মীর জুমলা গেটের (ঢাকা গেট) উপর দিয়ে এবং সন্ত্রাসবিরোধি রাজু ভাস্কর্যের একেবারে গা ঘেঁষে মেট্রোরেলের লাইন যাবে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার মাজারও সেখানে রয়েছে। এতে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ত্রিমাত্রিক সৌন্দর্য (রাজু ভাস্কর্য) যেমন নষ্ট হবে, তেমনি প্রতি সাড়ে তিন মিনিট অন্তর মেট্রোরেলের যাতায়াতে সৃষ্ট কম্পনে (প্রতিবেদনে যেটাকে বলা হচ্ছে সিগনিফিকেন্ট) স্থাপনাগুলোর স্থায়িত্বও হুমকির মুখে পড়বে।

 

আমাদের পহেলা বৈশাখ, মেট্রোরেলের নিচে মঙ্গল শোভাযাত্রা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অনন্য আয়োজন পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতি বছরেই নতুন নতুন থিম নিয়ে নানা ধরনের মোটিভ তৈরি করেন শিল্পীরা, যাতে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি মূর্ত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রার যে ব্যাপক আয়োজন, তার জন্যে যে উš§ুক্ত প্রান্তর প্রয়োজন, তা অনেকটাই সংকুচিত হয়ে যাবে মেট্রোরেলের কারণে। মেট্রোরেলের শব্দে বিঘ্ন হবে টিএসসি’র সাংস্কৃতিক মহড়া, নাটম­লের কার্যক্রম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাউন্ড-প্রুফ লাইব্রেরি করে দেবার কথা বলেছেন, কিন্তু ক্লাশ রুম? সেমিনার লাইব্রেরি? পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে তো আর সাউন্ড প্রুফ করা সম্ভব নয়।

 

স্টপেজ সংক্রান্ত সমস্যা
প্রস্তাবিত মেট্রোরেল প্রকল্পে দোয়েল চত্বরের কাছে একটি স্টপেজ রাখা হয়েছে। বিষয়টি এমন নয়, এই স্টপেজে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই নামবেন। পুরোনো ঢাকার বিভিন্ন দিকে যাতায়াতকারীরাও এই স্টপেজে নামবেন। প্রতিটি স্টপেজে রিকশা-সিএনজিসহ নানা ধরনের যানবাহনের একটি ‘অলিখিত’ স্ট্যান্ড তৈরি হয়। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, ফার্মেসী ও প্রকৌশল অনুষদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে একটি বড়ো ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। এমনিতেই দোয়েল চত্বর মোড়ে যে পরিমাণ যানবাহনের আসা-যাওয়া চলে, তাতে শিক্ষার্থীদের নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। তার উপর এখানে যদি স্টপেজও নির্মাণ করা হয়, এটি এতোটাই যানবাহনপূর্ণ হয়ে উঠবে যে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য চলাফেরা করাই বিপদ হয়ে দাঁড়াবে।

 

আমরা কখনোই রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি না। যদি এমন হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া মেট্রোরেল স্থাপনের আর কোনো পথ নেই, তাহলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু বিকল্প সোজা পথ থাকা সত্ত্বেও, ঘুর পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেল যৌক্তিকভাবেই আমাদের আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার মূল্যবান বক্তব্যে বলেছেন, আমরা তো চার বছর পর আর ক্যাম্পাসে থাকবো না। তাহলে কেনো আমরা আন্দোলন করছি। করছি কারণ, আমাদের ভবিষ্যত্ যেমন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে দিচ্ছে, তেমনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতের ভালোটুকু দেখবার বোধও আমাদের এই আন্দোলনে রাস্তায় নামিয়েছে।

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে যে খ­িত বত্তব্য আপনার কাছে পৌঁছেছে, এই খোলা চিঠির মধ্য দিয়ে তার অবসান হবে বলে আমরা আশা করছি। আপনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন; সুতরাং আমাদের আবেগ ও যুক্তি কোনোটাই আপনার বোধগম্যতার বাইরে নয়— এ বিশ্বাস আমরা আপনার প্রতি রাখতে চাই।

পরবর্তী কর্মসূচিঃ
আগামী ২০ জানুয়ারি ২০১৬, বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে রোড পেইন্টিং ও সকাল ১১টায় সংহতি সমাবেশ।

 

লেখাপড়া২৪.কম/ঢাবি/এমএইচ-৪৭১

পছন্দের আরো পোস্ট