বাইশের বাইশে তিনি
আজ (২২ ডিসেম্বর), ১৯৯৩ সালের এই দিনে অর্থ্যাৎ ২২ বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২তম ব্যাচের আগমন হয়। অন্য যে কোন ব্যাচের তুলনায় ২২তম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের কার্যক্রম ছিল চোখে পড়ার মত।
তাদের কার্যক্রম ক্লাসের গন্ডি পেরিয়ে মাঠ, মুক্তমঞ্চ, চৌরঙ্গী, প্রান্তিক গেইটসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ছিল দৃশ্যমান। রাজনীতির মাঠ কাঁপানো মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাও ছিল এই ব্যাচেরর মধ্যমনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার সাময়ে যতগুলো আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল তার পুরো ভাগে ছিল ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
ঐ ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যকার বন্ধন এতই দৃঢ় ছিল যে, যে কোন একজন যখনই বিপদে বা অসুস্থতায় পড়েন অন্য সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজ নিজ সামর্থ অনুসারে। বর্তমানের ২৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশের নানা জায়গায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
স্মৃতির টানে নানা ব্যস্ততা ভূলে আগামী ২৫শে ডিসেম্বর এই ব্যাচের দেখা মিলবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসে। এই ব্যাচের মেধাবী শিক্ষাথী ও বর্তমানে পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আলমগীর কবীরের জীবনের পথ চলা ও সফলতার নানা দিক নিয়ে লিখেছেন লেখাপড়া টোয়েন্টিফোর ডটকমের জাবি প্রতিনিধি নুর আলম হিলেম।
ড. আলমগীর অন্যসব সহপাঠিদের মতই ২২ ডিসেম্বর পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র এবং শহীদ সালাম বরকত হলের মাধ্যমে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেন। অন্য সহপাঠিদের তুলনায় একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বেঁড়ে উঠা ড. আলমগীর মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাকে হারান এবং দশ বছর বয়সে তার বাবা দুুস্কৃতিকারী কর্তৃক নির্মমভাবে নিহত হন।
রাজনৈতিক পরিবারে (বাবা: ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ১৯৭৩-১৯৮৪, থানা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাধারণ সম্পাদক ও সমাজসেবী, বড় ভাই: জেলা ছাত্র নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান, থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের উপজেলা কমিটির সভাপতি) বেড়ে উঠা ড. আলমগীরের অন্যতম আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনীতি করা এবং জাকসু ভিপি নির্বাচিত হওয়া।
সেই লক্ষ্যে ১ম বর্ষ থেকেই কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। বিভাগ ও হল পর্যায়ে খেলাধুলা, মুক্তমঞ্চে নাটক এবং অন্যান্য সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে সকলের কাছে ধীর ধীরে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। ১ম বর্ষের ফলাফল ঘোষনার পরই পাল্টে যায় তার জীবনের গতিপথ। আঁশিজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ১ম হন ড. আলমগীর।
তারপর কঠোর অধ্যবস্যায় এবং ফলাফল ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। অতিরিক্ত চেষ্টা তাকে একটু পিছিয়ে দেন এবং তিনি অনার্সে অর্জন করেন প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান। পরবর্তীতে মাস্টার্সে ১ম শ্রেণীতে প্রথম স্থান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং পাশ করার ৪ মাসের মধ্যে ২০০০ সালে পরিসংখ্যান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন তিনি।
২০০২ সালে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট (প্রভাষক ক্যাটাগরি) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দী প্রার্থিকে প্রায় ৭০ ভোটে হারিয়ে নির্বাচিত হন সিন্ডিকেট সদস্য। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সনে অনুষ্ঠিত সিনেট নির্বাচনে (৩৩ জনের মধ্যে) ৩য় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন সর্ব কনিষ্ঠতম সিনেট সদস্য এবং ভূমিকা রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে।
আবাসিক শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন আল-বেরুনী হল এবং জাহানারা ইমাম হলে। ২০০৫-২০১০ পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিভাগ এ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টা, খেলাধুলা বিষয়ক দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু ফেলোশীল অন সায়েন্স এন্ড আইসিটি নিয়ে পিএইচডি করতে যান মালয়েশিয়ার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় University of Malaya তে। মাত্র ২ বছর ১০ মাসেই তিনি জমা দেন Ph.D গবেষণা থিসিস। তিনি ১ম বাংলাদেশী হিসাবে অর্জন করেন “Ph.D Candidate with Highest Impact Publications Award-2013” অর্থ্যাৎ পিএইচডি গবেষনাকালে তিনি প্রায় ১৮টি গবেষনা পেপার আর্ন্তজাতিক মানের (ওঝও-জধহশবফ-ওসঢ়ধপঃ) জার্নালে প্রকাশ করেন।
অ্যাওয়ার্ড হতে প্রাপ্ত অর্থ তিনি দান করেন চ্যারিটি অর্গানাইজেশনে। শিক্ষা ও গবেষনায় তিনি ভ্রমন করেন মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং জামানী।
জার্মানীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় (Bielefeld University) থেকে পাবলিক হেলথএ 3-Credit এর একটি কোর্সও সম্পন্ন করেন। বিদেশে পড়াশুনার সময় তিনি মিলিত হন আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রানপুরুষ ড. মাহাথির মুহাম্মদ, সিঙ্গাপুরের হেলথ প্রোমোশন বোর্ডের প্রধানের সাথে, আমেরিকার Secretary of State (Health) এবং সাক্ষাৎ করেন অনেক নোবেল প্রাপ্ত গবেষক ও বিজ্ঞানীদের সাথে।
এছাড়া ২০০৩ সনে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর পৈত্রিক বাড়িতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, ২০০৭ সনে গুলশানের আইভি ভবনে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং ২০১৪ সনে মন্ত্রিদের শফত অনুষ্ঠানে বঙ্গভবনে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুল হামিদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
২০১৪ সনের ৩০ জানুয়ারী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট এবং ডিসিপ্লিনারী কমিটি সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. আলমগীর। তিনি বর্তমানে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক এবং জাবি একাডেমিক কাউন্সিলের সম্মানিত সদস্য। প্রায় ত্রিশের অধিক গবেষনা কর্ম প্রকাশিত হয় দেশ বিদেশের বিখ্যাত জার্নাল থেকে। তিনি দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নালের Reviwe এবং Editoral Board এর সম্মানীত সদস্য। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রফেশনার বডির আজিবন সদস্য এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান সমিতির সহ-সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অতিথি শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছেন/করছেন বেশ কয়েকটি সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি অব প্রফেশনালর্স, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মধ্যে অন্যতম।
তাছাড়া তিনি গন বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিভিন্ন দাতা সংগঠন যেমন, UNICEF, USAID, UNFPA, ADB এবং EU Funded বিভিন্ন Porject-এ পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন/করছেন।
শিক্ষকতা ও রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সেবায় নিয়োজিত এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আমিজ ফাউন্ডেশন’, জয়নব পূর্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য, বি-বাড়ীয়া জেলা ছাত্র-কল্যাণ সমিতির (জাবির) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বর্তমান পৃষ্টপোষক।
তাছাড়া তিনি বর্তমানে ঢাকার অদুরে সাভারে অবস্থিত সিআরপি-এর Ethics কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে তিনি উপদেষ্টা হিসাবেও কাজ করছেন।
ড. আলমগীর মনে করেন, ২২তম ব্যাচের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীই মেধাবী এবং তারা সকলেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছেন এবং রাখবে। তারা তাদের ব্যাচের সকলকে নিয়ে একটি সংগঠন করারও পরিকল্পনা করছে এবং তার মাধ্যমে ব্যাচের সদস্য ও তাদের পরিবার পরিজন তথা জাতি উপকৃত হবে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন আগামী ২৫ ডিসেম্বর তাদের ব্যাচের পূর্ণমিলনী হবে এবং আমরা আরও জানবো আমাদের বন্ধুদের সর্বশেষ অগ্রগতি। তিনি উক্ত অনুষ্ঠানে আগত সবাইকে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
লেখাপড়া২৪.কম/জাবি/হিলেম/এমএএ-০৪৫৪