‘প্রাথমিক শিক্ষার সব সূচকেই উন্নতি করছে বাংলাদেশ’

4_163938

Post MIddle

প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় প্রতিটি সূচকেই ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে বাংলাদেশ। এখন সময় এসেছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার। পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার মান বৃদ্ধির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এলজিইডি-আরডিইসি ভবন মিলনায়তনে ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০১৫’-এর ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন থেকে টেকসই ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা যে ধাপে ধাপে এগিয়েছে; প্রকাশিত গবেষণাপত্রে সেটিই স্বীকার করা হয়েছে। উন্নয়ন সূচকগুলোতে দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে, অনেকের মধ্যে এ নিয়ে সংশয় থাকলেও আমার মধ্যে তা নেই। বরং আমি বলি, উন্নয়নের মূলমন্ত্র এ দেশের মানুষ শিখে নিয়েছে। এখন দেশের প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধি এসেছে যে, শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে উপবৃত্তি বা টিফিন দেয়ার বাইরে থাকা স্কুলেও শিক্ষার্থীর অভাব হয় না। মসজিদ-মাদরাসায় নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে যা-ই বলা হোক না কেন, বাবা-মা ছেলের পাশাপাশি মেয়েদেরও স্কুলে পাঠাচ্ছেন। এ সচেতনতা ধরে রাখা গেলে বহির্বিশ্ব থেকে যতই বলা হোক এদেশে জঙ্গি আছে, আইএস আছে_ এদেশ তরতর করে এগিয়ে যাবে। যেসব দেশ লাদেন কিংবা আইএস ধুঁয়ো তুলছে, তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামোগত অগ্রগতি আনন্দের বিষয়। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিকে ভর্তিতে মেয়েরা এগিয়ে থাকলেও পরিবারে খাদ্যপুষ্টি বণ্টনে তারা পিছিয়ে রয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নতি ধরে রাখতে হলে সরকারকে এদিকেও নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জে জয়ী হলেই চলবে না, এখন আমাদের মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মাধ্যমিকে শিক্ষার মানে ভয়াবহ ঘাটতি রয়েছে। এমডিজি থেকে এসডিজিতে যেতে মানসম্মত মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের আরেক সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে নানা বিষয়ে অনৈক্য থাকলেও অগ্রগতির প্রশ্নে এদেশের সবাই ঐক্যবদ্ধ। এজন্যই অগ্রগতির সব সূচকে বাংলাদেশ উন্নতি করছে।
গবেষণা সহযোগী ডিএফআইডি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-শিক্ষা বিষয়ক টিম লিডার ড. ক্যারোলিন সানার্স বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে এগিয়ে চলেছে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট কাজী রফিকুল আলম।
অনুষ্ঠানে গবেষণা তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেন মুখ্য গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ। তিনি বলেন, দেশের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামর্থ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। শ্রেণীকক্ষের সংখ্যা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও বিশুদ্ধ পানির সুবিধার সঙ্গে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও উন্নতি দেখা দিয়েছে। শতকরা ৮০ ভাগ তরুণ এখন শিক্ষিত।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার এখন সাড়ে ৯৪ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শতভাগ শিশুকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির লক্ষ্য অর্জন করতে সরকারের আরও অন্তত চার বছর লাগবে। অপরদিকে ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ৭৮ শতাংশের কিছু বেশি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। এ হিসাবে ২২ শতাংশ শিশু এখনও প্রাথমিকের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিদ্যমান কৌশলে সব শিশুকে প্রাথমিক স্তরে ধরে রাখতে আরও অন্তত ৩৫ বছর লাগবে।
‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন থেকে টেকসই ভবিষ্যৎ : প্রয়োজন মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির গতি বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়, বিদ্যালয়ে অভিগম্যতার প্রতিটি নির্দেশকের ক্ষেত্রেই সময়ের সঙ্গে উন্নতি ঘটেছে। নিট ভর্তির হার ১৯৯৮ সালে ছিল ৭৭ শতাংশ। ২০১৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ৬ থেকে ১০ বছর বয়সীদের ভর্তির হার ১৯৯৮ সালে ছিল ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ; ২০১৩ সালে তা ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌগিক প্রবৃদ্ধি মডেল ব্যবহার করে প্রাথমিক শিক্ষা ও এতে ভর্তিসহ অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্য সময় বের করা হয়েছে। এতে ২০১৩ সালকে ভিত্তি বছর ধরে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাথমিকে সব শিশুর ভর্তি লক্ষ্য অর্জিত হবে ৬ বছর পর বা ২০১৯ সালে। আর ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী সব শিশুকে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি করার লক্ষ্য অর্জন হবে ২০৫০ সালে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এমডিজি) সবার জন্য শিক্ষার লক্ষ্য ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জিত হয়নি। এসব অসমাপ্ত কাজসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর (এসডিজি) অংশ হিসেবে নিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে হবে। এজন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে বলা হয়, বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ও প্রাথমিক শিক্ষা অসমাপ্ত রাখা, বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশু, সন্তোষজনক শিখনফল অর্জন এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিতকরণে অসমাপ্ত কাজগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এসডিজির শিক্ষা সংক্রান্ত বৃহত্তর লক্ষ্য। এর মধ্যে আছে_ সব শিশুকে প্রাক-শৈশব উন্নয়ন ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিখতে ও বেড়ে উঠতে সহায়তা করা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত উন্নীত করা, অধিকতর শিখনের জন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বৃদ্ধি করা, সমাজে জীবনব্যাপী শেখার সুযোগ প্রসারিত করা ইত্যাদি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার নিরিখে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে কিন্ডারগার্টেন ও উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়। ৩৭ শতাংশ কিন্ডারগার্টেন নিজস্ব জমিতে আর ১২ শতাংশ অন্যের কাছ থেকে জমি ধার করে ভবন তৈরি করেছে। বিদ্যালয়গুলোতে গড়ে ৪ দশমিক ৮টি কক্ষ আছে। এতে আরও বলা হয়, মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত কর্মকা- ও কার্যকর শিখন পরিবেশ দরকার। তবে বিদ্যালয়গুলোতে গড়ে শিক্ষক আছেন ৬ দশমিক ২ জন। বিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষকের অনুপাত ক্রমেই বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে মোট শিক্ষকদের ৩২ শতাংশ ছিলেন নারী। এ হার ২০০৮ সালে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৪ সালে ৫৭ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষকই স্নাতক ডিগ্রিধারী। একই বছর মৌলিক প্রশিক্ষণ (সিইনএড, বিএড, এমএড, ডিপইনএড, এনজিও কর্তৃক প্রদত্ত শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণ) পাওয়া শিক্ষক ছিলেন ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপরও প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত এখনও একটি বড় সমস্যা। এ অনুপাত ১৯৯৮ সালে ছিল ৪৬, যা কমে ২০০৮ সালে ৩৯ হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ৪৩ হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সদস্যদের গড় শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার বেড়েছে। ১৯৯৮ সালে এ হার ছিল ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ। পাঁচটি শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের সম্মিলিতভাবে এক শ্রেণী থেকে পরের শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার হার ১৯৯৮ সালে ছিল ৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে ৯২ শতাংশ হয়েছে। ক্যাম্পে বলছে, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার অভ্যন্তরীণ দক্ষতার মাত্রা ছিল ৭৫ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০০০ সালে ছিল ৭৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ছিল ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
প্রতিবেদনের নীতি সংক্রান্ত অংশে আটটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_ বিভিন্ন ধরনের বিদ্যালয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন শিক্ষার জোগান ও প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিষয়ে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা।
আইন অনুযায়ী যথাযথ বয়সে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি উৎসাহিত করা। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেয়া। শিক্ষার গুণগত মানের ওপর জোর দেয়া ও সব শিশুর শিক্ষায় প্রবেশের অধিকার ও অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা। শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ ব্যাপকভাবে বাড়ানো।#

 

লেখাপড়া২৪.কম/আরএইচ-৫০৭৭

পছন্দের আরো পোস্ট