নারীর প্রতি অপরাধ দমনে নৈতিক শিক্ষা জরুরি

‘এ জগতে যা কিছু মহান চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ শাশ্বত মহান বাণী সর্বজনীন ও চিরস্মরণীয়। বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নে নারীর ভূমিকা উপলব্ধি করে এবং নারী শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বিশ্ব মানব সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সভা, সম্মেলনের আয়োজন করে চলেছেন। ২২ জুলাই লন্ডনের ওয়ালওয়ার্থ একাডেমিতে ব্রিটিশ সরকার এবং ইউনিসেফের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ‘গার্ল সামিট’। কন্যাশিশু সম্পর্কিত এটি প্রথমবারের মতো সম্মেলন। বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কন্যাশিশুদের অধিকার সুরক্ষা ও তাদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতের জন্য বিশ্বের ৫০টিরও বেশি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, চ্যারিটি এবং এনজিও এ সম্মেলনে অংশ নেয়। এ বালিকা সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল মেয়েদের স্বার্থবিরোধী দুটি সামাজিক প্রথা-ফিমেইল জেনিটাল মিউটিলেশন (এফজিএম) এবং শিশু, বাল্য ও জোরপূর্বক বিয়ে প্রতিরোধ। নারীর বিরুদ্ধে এরকম প্রথা শুধু অন্যায়ই নয় বরং অপরাধমূলক।প্রাথমিক বিদ্যালয়

জেনিটাল মিউটিলেশন বা ‘জননেন্দ্রিয়ের অঙ্গহানি’ অত্যন্ত বর্বরোচিত প্রথা, যা পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে এখনও প্রচলিত আছে। আর শিশুবিয়ে, বাল্যবিয়ে এবং জোরপূর্বক বিয়ে একই রকম অপরাধ, যা পৃথিবীর সব দেশেই ঘটছে কম আর বেশি। ‘ফিমেইল জেনিটাল মিউটিলেশন’ যে কত বর্বরোচিত প্রথা এবং শিশুবিয়ে কিংবা বাল্যবিয়ে এবং জোরপূর্বক বিয়ে যে কত বড় মানবিক, পারিবারিক, সামাজিক, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে যে কোনো সচেতন মানুষই সেটি বুঝতে পারেন। মেয়ে শিশুটি বা বালিকাটি হয়তো আমারই বা আমার কোনো প্রতিবেশীর বা সমাজেরই একজন। এরকম উপলব্ধি মানুষের মধ্যে জাগ্রত করার জন্যই আইনকানুন, সম্মেলন, প্রচারণা ও যথার্থ প্রয়োগ অবশ্যই মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক।

পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি নারী উন্নয়নের জন্য, নারীর অধিকার রক্ষার জন্য ডজন খানেকের মতো আইন রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন জাতিসংঘের আয়োজনে ১৯৯৫ সালে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্র অংশ নেয়। তাদের মধ্যে বৈশ্বিক ঐকমত্য স্বরূপ  (Global Consensus) পৃথিবীর দেশগুলো নিজ নিজ দেশে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে সেটিকে জাতীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এছাড়া ঈঊউঅড সনদের কথাও আমরা জানি। এসব আন্তর্জাতিক আয়োজনের বাইরেও দেশীয় পর্যায়ে বহু আইন তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ ১৯২৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন সংশোধনী আইন ২০০৩, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২, এসিড অপরাধ দমন আইন ১৮৮৪ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আবার পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ ইত্যাদিসহ বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯-এর মাধ্যমে নারীর অধিকার সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এছাড়া ২০১১ খ্রিস্টাব্দে সরকারের গৃহীত জাতীয় শিশুনীতি এবং ২০১৩-এর বাল্যবিয়ের শিকার শিশু-মেয়েদের সুরক্ষা দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। আমাদের দেশের নারী নেত্রীরাও নারীর অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার এদেশের নারী সমাজকে যখন গৃহবন্দি করে রেখেছিল, মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া তখন নারী শিক্ষা উন্নয়নের পথ দেখিয়ে গেছেন। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, নারীর কর্মসংস্থান বেড়েছে, ক্ষমতায়নও কিছুটা ঘটেছে, বাল্যবিয়েও অনেকটা কমেছে, স্বীকার করতেই হয়। তবে জাতিসংঘ ও সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে এখনও ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ মেয়ের বিয়ে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই সম্পন্ন হচ্ছে।

Post MIddle

‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে’ একজন পুরুষের বয়স ২১ বছরের নিচে এবং একজন মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম হলেই তাকে শিশু বলা হয়। এ আইনে যে কোনো শিশুর বিয়েই নিষিদ্ধ। বাল্যবিয়ে যিনি সম্পাদন করবেন, এরকম বিয়েতে যিনি নির্দেশ দেবেন এবং পিতামাতা বা আইনানুগ অভিভাবক যদি এ ধরনের বিয়েতে যথাযথ বাধা প্রদান না করেন তাহলে সেও ওই আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধী। আমরা মনে করি, এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- অথবা ১ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় ধরনের দন্ডে দন্ডিতের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। তবে আইন যতই সৃষ্টি হোক, যদি তার যথাযথ প্রয়োগ না হয় তাহলে আইন তৈরি অর্থহীন হয়ে যায়। বাংলাদেশে হিন্দুদের উত্তরাধিকার আইন এবং মুসলিমদের উত্তরাধিকার আইনের যথাযথ ও যুগোপযোগী পরিবর্তন ও সংস্কার যদি আনা যায়, তাহলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন অনেকটা শক্তিশালী হতে পারে। বিশেষ করে, বাংলাদেশে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

ভারতীয় হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের মতো একই গ্রেড ও ডিগ্রির পুরুষ-নারীর সমান সম্পত্তি পাওয়ার বিষয়টি অনুসরণ করে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করা খুবই জরুরি। এদিকে কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াসের আলোকে যদি মুসলিম উত্তরাধিকার আইনেরও যথাযথ যুগোপযোগী পরিবর্তন বা সংস্কার করা যায়, তাহলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শক্তিশালী হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন বৈষম্যহীন শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপক প্রসার ও প্রচার। শিক্ষা মানেই জানা, বোঝা ও প্রয়োগ। আমরা প্রত্যাশা করি, শিক্ষা হোক নৈতিক, মানবিক, উদার ও যুগোপযোগী। আইন হোক যথাযথ এবং তার প্রয়োগ হোক বাস্তবসম্মত, কঠোর এবং কার্যকরী। তাহলেই লন্ডনের গার্ল সামিট পৃথিবীতে নারীর প্রতি নির্যাতন, সন্ত্রাস, সহিংসতা দূর করতে পারবে এবং মানব সভ্যতা শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নে এগিয়ে যাবে।# (সৌজন্যে-আলোকিত বাংলাদেশ)

 
ড. রেবা মন্ডল

কলাম লেখক ও অধ্যাপক, ইবি।

পছন্দের আরো পোস্ট