বন্ধ করা যাচ্ছে না কোচিং ব্যবসা

বাংলাদেশে শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা বন্ধে শাস্তির বিধানসহ নীতিমালা প্রণয়নের পরও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না৷ এক শ্রেণির শিক্ষকরা নানা কৌশলে তাঁদের এই ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন৷ প্রতিষ্ঠান প্রধানরা তা স্বীকারও করছেন৷শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে গত বছরের জুন মাসে৷ এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে পারবেন না৷ আর অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একদিনে সর্বোচ্চ ১০ জনকে কোচিং করাতে পারবেন৷ তবে তা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে৷ এই নীতিমালা ভঙ্গের জন্য চাকরিচ্যুতিসহ নানা শাস্তিরও বিধান রাখা হয়েছে৷ কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷

রাজধানীর নামিদামি স্কুলের শিক্ষকরাই এই কোচিং ব্যবসার সঙ্গে বেশি জড়িত৷ তাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং-এ বাধ্য করেন বলেও অভিযোগ৷

মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক অধিদপ্তরের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, নীতিমালা ঠিক মতো মানা হচ্ছে না৷ বন্ধ হচ্ছে না কোচিং ব্যবসা৷অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর ফাহিমা খাতুন এর মতে, তাঁরা চেষ্টা করছেন এই নীতিমালা বাস্তবায়নের৷ তবে এতে একটু সময় লাগবে৷

Post MIddle

জানা গেছে, কোচিং বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে গত মাসে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের ২৮ জন শিক্ষককে শাস্তি দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু ইনক্রিমেন্ট স্থগিতের মতো মামুলি শাস্তিতে তাঁরা দমেন নি৷ অব্যাহত রেখেছেন কোচিং ব্যবসা৷

দেশের শতাধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫ শতাধিক শিক্ষক কোচিং বাণিজ্যে জড়িত রয়েছেন। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেশব্যাপী অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু গণিত ও ইংরেজির শিক্ষকই নন, ধর্ম, বাংলা, চারুকলা, কারিগরি ও কৃষিশিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞানের মতো বিষয়েও কোচিং করতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়। শিক্ষকরা হচ্ছেন বিদ্যা ও জ্ঞানদাতা। ঘরে ঘরে জ্ঞান-প্রদীপ প্রজ্বলনে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য সমাজে তারা পূজনীয় ও আদরণীয়। জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত করার মহৎ দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকসমাজ অর্থ লোভে মত্ত হয়ে স্বীয় মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত করছেন, বিষয়টি দুঃখজনক। ন্যায়-নীতি ও সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে স্কুলে স্কুলে যে কোচিংরাজত্ব কায়েম করেছেন, অবিলম্বে তা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। দেশে প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য অনেকটা মহামারীর রূপ ধারণ করায় সরকার ২০১২ সালের জুন মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের  কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়ে নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালা জারির পর প্রকারান্তরে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য এখন অনেকটা বৈধ হয়ে গেছে। বস্তুত নীতিমালায় কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপারে যে নির্দেশনা রয়েছে, তার অপপ্রয়োগ হচ্ছে।
গাইড ও নোটবই এবং প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর বিধান রেখে দেশে প্রথমবারের মতো যে খসড়া শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়, সেখানে এ আইন লংঘনে ধারা বিশেষে সর্বনিু ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও সর্বনিু ৬ মাস থেকে এক বছর জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। দেশে যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে এ ধরনের একটি আইন প্রণয়ন জরুরি ছিল- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আইন কার্যকর করা নিয়েই প্রশ্ন। বলার অপেক্ষা রাখে না, কোনো আইন যদি কার্যকর করা না যায়, তবে তা প্রণয়ন করা আর না করা সমান কথা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, জ্ঞান বিতরণের কাজটি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। বর্তমানে অবস্থা যা, তাতে মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিবোধের উন্নয়ন না ঘটিয়ে শুধু আইন দিয়ে অবস্থার পরিবর্তন কতটা সম্ভব- এ ব্যাপারে সংশয় রয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা ও কথাবার্তা কম বলা হয়নি। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি ও রাজনীতিকরণের ঘূর্ণাবর্তে তার অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে হলে সরকারকে আন্তরিকতা ও সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী কোচিংবাজ ৫০৬ জনের মধ্যে ২ শতাধিক শিক্ষককে বদলি করা হলেও অনেকেই ঘুষ দিয়ে, প্রভাবশালীদের সুপারিশ নিয়ে এবং নানাভাবে তদবির করে আবার আগের কর্মস্থলে ফিরে এসেছেন। জানা গেছে, এর সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের একশ্রেণীর কর্মকর্তা জড়িত। এই যদি হয় প্রকৃত অবস্থা, তবে নীতি ও আদর্শের জায়গা থেকে যত বড় বড় কথাই বলা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার কথাও সরকারের ভাবা উচিত। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের বৈষম্যের বৃত্তে বন্দি রেখে কোচিং বাণিজ্য বন্ধের বিষয়টি কতটা ফলপ্রসূ করা যাবে, ভেবে দেখা দরকার।
পছন্দের আরো পোস্ট