ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো ইচ্ছামতো চলছে

images (7)ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকা সত্বেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া ও পৃথক নীতিমালা না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেকটা ইচ্বেছামতো ও পরোয়াভাবে চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ন্ত্রণের জন্য নামকাওয়াস্তে একটি শাখা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। নানা কৌশলে বছর বছর বেতন ও ফি বাড়ানো যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কুলগুলোতে। অতিরিক্ত ফির চাপে চিঁড়েচ্যাপ্টা দশা অভিভাবকদের। তাঁদের মতামতের কোনো মূল্যই দেয় না স্কুল কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে স্কুলগুলো। যে অভিভাবকরা প্রতিবাদ করছেন তাঁদের সন্তানদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ।

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বক্তব্যেও দায় বর্তায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘাড়েই। মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন এর সংবাদ মাধ্যমে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী ‘আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ২৪টি স্কুলকে নোটিশ দিয়েছিলাম। দুটি স্কুল আমাদের নোটিশ গ্রহণ করেনি। কিছু স্কুলে আমাদের প্রতিনিধিরা গিয়েছেন। কেউ কেউ আদালতের আদেশ মানার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। যেহেতু ঢাকা বোর্ড রেজিস্ট্রেশন দেয়, তাই যারা আদালতের আদেশ মানেনি তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডকে বলা হয়েছে। এর বাইরে তো আমাদের কিছু করার নেই।’
images (6)“আমরা শুধু ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল স্কুলগুলোকে রেজিস্ট্রেশন দেই। কোনো স্কুলের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো বিধি নেই। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো তাদের ইচ্ছামতো চলে। কারিকুলাম, সেশন ফি, শিক্ষক নিয়োগ তাদের ইচ্ছামতো করে। তাদের নীতিমালার মধ্যে আনার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি স্কুলের ধানমণ্ডি শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘সম্প্রতি দেওয়া ফলাফলে আমার ছেলেকে ধর্ম বিষয়েও অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। অথচ প্রতিটি পরীক্ষা সে দিয়েছে। ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে আন্দোলন করায় আমার ছেলের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। আমি চ্যালেঞ্জ করেছি। তবে এখনো পুনঃ ফল জানায়নি।’
একই স্কুলের ওয়ারি শাখার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করে বলেন, যারা আন্দোলন করবে, তাদের সন্তানদের পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি করা হবে না বলে স্কুল থেকে জানানো হয়েছে। ফলে কষ্ট হলেও স্কুলের চাহিদামতো ফি দিতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা।
‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর রেজিস্ট্রেশন দেয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। তাদের তথ্যমতে ঢাকা বোর্ডের অধীনে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে ৯৩টি স্কুল। এর বাইরেও ৩১টি স্কুল আছে। রেজিস্ট্রেশন ঢাকা বোর্ড থেকে নিলেও তাদের পরীক্ষা হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের আওতায়।
images (4)বেনবেইসের ২০১১ সালের তথ্যানুযায়ী, সারা দেশে তিন ক্যাটাগরিতে ১৫৯টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল রয়েছে। ‘ও’ লেভেলের ৬৪টি এবং ‘এ’ লেভেলের ৫৪টি; জুনিয়র লেভেলের ৪১টি। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সারা দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ হাজার। এসবের মধ্যে অলিগলিতে গজিয়ে ওঠা স্কুলের সংখ্যাই বেশি। তারা কোনো কারিকুলামের ধার ধারে না। নিজেদের কারিকুলামে জুনিয়র লেভেল পর্যন্ত পড়ায়।
images (5)সম্প্রতি সেশন চার্জ বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছেন অভিভাবকরা। একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বেঞ্চ দেশের সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পুনঃ ভর্তি বা সেশন চার্জ আদায়ের ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। একই সঙ্গে এসব স্কুলের মাসিক বেতন, সেশন চার্জের বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন ও মনিটরিং সেল গঠনে সরকারকে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি রুল জারি করেন। চার সপ্তাহের মধ্যে এর জবাব চাওয়া হয়। তবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের পক্ষ থেকে আদালতের কাছে আরো সময় চাওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
Post MIddle
হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা আমলে নিচ্ছে না ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো। কোনো কোনো স্কুল সেশন চার্জ না নিয়ে নানা কৌশলে মাসিক বেতন বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অভিযোগে গত ৩ জুন আরেক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাসচিব, মাউশি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালক এবং স্কলাস্টিকা, সানি ডেল, সাউথ ব্রিজ, ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড ও ম্যাপললিফ স্কুলের অধ্যক্ষকে আদালত অবমাননার নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বর্ধিত ফি অভিভাবকদের ফেরত দিতে বলা হয়েছে। না দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। রিটকারীর আইনজীবী জানান, এরপর আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরবর্তী অবস্থা জানা যায়নি। আদালত খুললে কী জবাব এসেছে তা জানা যাবে।
শিক্ষার্থীদের অভিভাবকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, একটি স্কুলের নার্সারি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা, তা বাড়িয়ে করা হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার টাকা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছিল সাত হাজার ৭০০ টাকা, সেটা করা হয়েছে ৯ হাজার ৭০০ টাকা। ধানমণ্ডির আরেক স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে মাসিক বেতন ছিল পাঁচ হাজার ১০০ টাকা, এখন করা হয়েছে সাত হাজার ২০০ টাকা। নার্সারিতে চার হাজার থেকে বাড়িয়ে ছয় হাজার টাকা করা হয়েছে। অন্য একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে সেশন চার্জ ছিল ১৪ হাজার টাকা, আর মাসিক বেতন ছিল চার হাজার ৬০০ টাকা। এখন বেতন দুই হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীর বেশকিছু স্কুল আদালতের নির্দেশের পর সেশন চার্জ না বাড়ালেও বেতন বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সম্প্রতি সানি ডেল ও মাস্টারমাইন্ড স্কুল কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বেতন নেওয়া হবে না বলে অভিভাবকদের এসএমএসের মাধ্যমে জানিয়েছে।
আবার বেশকিছু স্কুল বেতন না বাড়ালেও সেশন চার্জ ঠিকই আদায় করছে। অভিভাবকরা জানান, ধানমণ্ডি একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি বাবদ নেওয়া হয় ৩৫ হাজার টাকা। মাসিক বেতন না বাড়িয়ে সেশন চার্জ দেওয়ার জন্য বলেছে কর্তৃপক্ষ। নামি দামি একটি স্স্কুলে প্লেতে ভর্তি করতেই লাগে দেড় লাখ টাকা, মাসিক বেতন ১১ হাজার টাকা। দিতে হয় সেশন চার্জও। উত্তরার একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি ফি ৬০ হাজার টাকা, আর মাসিক বেতন প্রায় সাত হাজার টাকা। তিন মাসের বেতন একসঙ্গে নেওয়া হয়। এভাবে প্রায় সব স্কুলেই নেওয়া হচ্ছে উচ্চ হারে ফি আর সেশন চার্জ।
জানা গেছে, আদালতের নির্দেশনা অনুসারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন ও মনিটরিং সেল গঠনের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এস মাহমুদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে একজন সদস্য বলেন, ‘আমরা নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। শিক্ষাবিদ, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের সভা শেষে তা চূড়ান্ত করা হবে।’
অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থদের সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ে বলে এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে তাঁরা নারাজ। আবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাদের চাপে পড়তে হবে, সে ভয়ও রয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি (ইংরেজি মাধ্যম) বিদ্যালয় নীতিমালা-২০০৭ প্রণয়ন করলেও তা কোনো কাজে আসছে না। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষার মান ও অবকাঠামোর কথা বিবেচনা করে ব্যবস্থাপনা কমিটি টিউশন ফি নির্ধারণ করতে পারবে। তবে ভর্তি নবায়ন বা পুনঃ ভর্তির নামে কোনো অর্থ আদায় করা যাবে না। ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আটজন সদস্য থাকবেন। প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ হবেন কমিটির সদস্যসচিব। তবে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে নামকাওয়াস্তে। মূলত পরিবারের সদস্যদের নিয়েই কমিটি করা হয়। ব্যবসাই এসব স্কুলের মূল উদ্দেশ্য।
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট রত্না আমিন বলেন, ‘স্কুলগুলোর ফি মেটাতে আমরা অভিভাবকরা খুবই সমস্যার মধ্যে রয়েছি। প্রতিবছর নতুন অজুহাতে ফি বাড়ানো হচ্ছে। মন্ত্রণালয় বাংলা মাধ্যমের এমপিওভুক্ত, আংশিক এমপিওভুক্ত বা পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভর্তি নীতিমালা প্রণয়ন করছে। তাহলে ইংলিশ মিডিয়ামের জন্য কেন পারবে না? নীতিমালা সংশোধন করে টিউশন ফি নির্ধারণের দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিবর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে।’
সরকার চলতি অর্থবছর থেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে। জুলাই থেকে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। অথচ কিছু স্কুল জুন মাসের বেতনের সঙ্গেই এ ভ্যাট যুক্ত করেছে। এ ছাড়া সেশনচার্জ ও অন্যান্য ফির সঙ্গেও এ ভ্যাট দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের চাপ দেওয়া হচ্ছে।
পছন্দের আরো পোস্ট