আনন্দময় শিক্ষার জন্য সুনিকেতন পাঠশালা

ooশিক্ষার সঙ্গে আনন্দ নেই। সন্তানেরা পাঠ্য বই মুখস্থ করে খাতায় গিয়ে উদগীরণ করছে মাত্র। শিক্ষা প্রসঙ্গে এটা আমাদের অনেকদিনের অভিযোগ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এমন অভিযোগ করেছেন। তিনি তার শান্তি নিকেতনের প্রকৃতির নিবিড়তায় ও আনন্দের মিলন ঘটিয়ে শিক্ষাথীদের মনের বিকাশে ব্রতী হয়েছিলেন। রবি ঠাকুরের সেই পাঠশালার মতো শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী উপজেলা কালীগঞ্জে।

 

২০০৩ সালে ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় বলিদাপাড়া নামক গ্রামে এই ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠানটির নাম দেয়া হয় ‘সুনিকেতন পাঠশালা’।

পাঠশালাটি এবছর ১১ তম বর্ষে পা দিয়েছে। শিশুকাল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে এখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম চলছে। বর্তমানে এখানে ২২০ ছাত্রছাত্রী অধ্যায়নরত রয়েছে।

শিল্পী এস এম সুলতানের চিত্রা নদীর পাড়ের প্রাকৃতিক ছন্দময় পরিবেশে একটি ৪তলা ভবনের সুসজ্জিত কক্ষে পাঠশালার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

 

শিক্ষার্থীদের পাঠদানকে আধুনিক এবং আনন্দময় করার জন্যে পাঠশালায় রয়েছে কম্পিউটার।

শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলার জন্য রয়েছে নানা ধরণের শিক্ষামূলক সিডি। পাঠশালাটিতে আরও রয়েছে একটি টেলিস্কোপ, একটি অনুবীক্ষণ যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ওজন মাপার মেশিন।
রয়েছে অসংখ্য দেশী-বিদেশী খেলার সামগ্রী। শ্রেণীকক্ষের নির্দিষ্ট সীমার বাইরে খোলা মাঠে নিয়ে খেলতে খেলতে শেখানোর মনোরম পরিবেশ রয়েছে এই পাঠশালায়। গ্রামের পরিবেশে এমন একটি শিক্ষালয় সত্যিই বিরল।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আলহাজ্ব রোকেয়া খাতুন জানান, সুনিকেতন পাঠশালায় শিক্ষার্থীদের মানসম্মত লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন স্বাস্থ্যসম্মত টিফিন দেয়া হয়। টিফিনের মেন্যু হিসেবে থাকে রুটি ও মধু অথবা খিচুরী ও ডিম।

Post MIddle

সংস্থার নিজস্ব চাষীদের কাছ থেকে পাওয়া মধু শিক্ষার্থীদের টিফিনের সাথে দেয়া হয়। টিফিন এর জন্য অতিরিক্ত কোন অর্থ নেয়া হয় না। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মিত ভিটামিন ‘সি’ ট্যাবলেট বিনামূল্যে দেয়া হয়ে থাকে।

এছাড়া এখানকার শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিয়ে নিয়মিত সভা করা হয়। সভায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়।

তিনি আরো জানান, সুনিকেতন পাঠশালার শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে থাকে। ধুমপান এবং মাদকবিরোধী র্যায়লি করা হয়। এছাড়া শিক্ষার পরিবেশ সুরক্ষা কর্মশালায় যোগদানের পাশাপাশি পাঠশালার পক্ষ থেকে নিয়মিত বিভিন্ন জাতীয় দিবস বর্ণাঢ্যভাবে আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পাঠশালার শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর ঘটা করে বনভোজনের আয়োজন করা হয়। বনভোজনে শিক্ষার্থীদের সাথে অভিভাবকরাও যোগ দেয়। যা শিক্ষার সাথে আনন্দ যোগের এক অনন্য উদাহরণ।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আতাউর রহমান মিটন জানান, শুরুতেই স্থানীয় সুধীজন ও স্বেচ্ছাসেবকদের আগ্রহে স্থাপিত হয়।
পরবর্তীতে পাঠশালার শিক্ষার পরিবেশ দেখে এর নির্মাণ এবং পরিচালনায় সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছেন ৬৫ বছর বয়সী সাইকো হিবিনো নামের এক জাপানী নারী। তাঁর আজীবনের স্বপ্ন শিশুদের জন্য সূর্যের মমতায় ঘেরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার।
তার ৩০ বছর ধরে রোজগারের জমানো অর্থ দিয়েছেন পাঠশালার ভবন নির্মাণের জন্য। পাঠশালার প্রশাসনিক খরচের একাংশ আসছে কোকোরো নো ভিটামিন নামে অপর একটি জাপানী প্রতিষ্ঠান থেকে। আর বাকিটা আসে শিক্ষার্থীদের দেয়া সামান্য মাসিক বেতন (শ্রেণীভেদে ৫০-৮০ টাকা মাত্র) থেকে।

 

হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড নামে একটি বেসরকারী সংস্থা এই পাঠশালাটি পরিচালনায় সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছে। সুনিকেতন পাঠশালার একটি অনন্য প্রয়াস হলো বৃত্তির ব্যবস্থা। সমাজে যাদের পক্ষে বেতন যোগান দেয়াটা সম্ভব নয়, তাদের জন্য সুনিকেতন পাঠশালার রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা। অর্থাৎ বেতন দিতে না পারলেও শিক্ষা বন্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

এই পাঠশালাটিকে একটি মডেল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করা হবে বলে অঙ্গীকার করেছেন উদ্যোক্তারা। তবে এর জন্যে সমাজের সকলের এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
ভবিষ্যতে সুনিকেতন পাঠশালার আদলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এরকম আরও মানসম্মত পাঠশালা গড়ে তোলা হলে শিক্ষার ঝরে পড়ার হার কমবে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে দেশে শিক্ষিতের সংখ্যা।
স: ইএইচ

পছন্দের আরো পোস্ট