আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙন কবলিত উৎরাইলের ছাত্রমিতালী পাঠাগার
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার আড়িয়াল খাঁ নদের ভাঙন কবলিত গ্রামটির নাম উৎরাইল। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন স্বপ্নবাজ ছাত্র সমাজকে বদলে দেয়ার চেতনায় ২০০৬ সালে গড়ে তোলে উৎরাইল ছাত্রমিতালী পাঠাগার।
ওই তরুণদের বিশ্বাস পাঠাগারের মাধ্যমেই সমাজকে বদলে দেয়া সম্ভব। দূর কথা সম্ভব সমাজের বিরাজমান অবিশ্বাস, কুসংস্কার। এসব তরুণরা স্বপ্ন দেখে সমাজের আঁধার তাড়িয়ে আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবে এ পাঠাগার।
এই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে তরুণদের উদ্যোগে গড়া উৎরাইল ছাত্র মিতালি পাঠাগার। শিবচরের উৎরাইল গ্রামটি নদী ভাঙন কবলিত হওয়া একটি অংশের শিশুরা প্রতি বছরই লেখাপড়া থেকে ঝরে যাচ্ছে। ঝরে যাওয়াদের হার কমিয়ে আনা, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মনোভাব এবং সৃজনশীলতার চর্চার সুযোগ করে দেয়ার প্রত্যাশায় এ পাঠাগার করার উদ্যোগ নেয় তারা।
উদ্যোক্তরা শুধু পাঠাগারটি তৈরিই করেননি। স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের পাঠাগারমুখী করার জন্য চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বাইরে আড্ডা দেয়া অনেক ছেলে-মেয়ে এখন পাঠাগারমুখী হচ্ছে। এখানে সপ্তাহের একদিন পাঠচক্রের আয়োজন করা হয়। পাঠচক্রে এলাকার ছাত্র-শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষ নিয়মিত অংশ নেন। পাঠাগারের ফলে এলাকার বয়স্করাও নিয়মিত এখানে বসে পত্রিকা পড়তে পারে। এদিকে, তরুণদের এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে এগিয়ে এসেছে উৎরাইল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।
পাঠাগারের একজন উদ্যোক্তা সহিদুজ্জামান সোহেল বলেন,‘তারা গ্রামের কয়েকজন তরুণ ২০০৬ সালের জুলাই মাসে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় পাঠাগার তৈরির। এই মানসিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চলতে থাকে পাঠাগার স্থাপনের প্রচার ও বই সংগ্রহ অভিযান। বন্ধু-বান্ধবসহ বিভিন্ন মহল থেকে বই সংগ্রহ করা হয়। পাঠাগার তৈরির প্রাথমিক অবস্থায় সামাজিকভাবে কিছুটা বিপত্তি আসলেও থেমে যায়নি উদ্যোক্তরা। তারপর ২০০৭ সালের জুলাই মাসে কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ১শ বই, ১টি টেবিল ও ১টি চেয়ার নিয়ে শুরু হয় পাঠাগারের কার্যক্রম। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিজেদের মধ্যে আর্থিক সাহায্যের অনুদান সংগ্রহ করে তৈরি করে নেয়া হয় কয়েকটি চেয়ার-বেঞ্চ-বুকসেল্ফ। ব্যবস্থা করা হয় নিয়মিত একটি সংবাদপত্র রাখার’।
সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, এই গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যকোনো বই পড়া ক্ষতিকর (!) বিষয়টি জেনে এসেছে এতদিন। অভিভাবকরা ক্লাশের বাইরের কোনো বই ছেলে-মেয়েদের পড়তে দিতেন না। উদ্যোক্তরা পাঠবিমুখ এসব ছেলে -মেয়েদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার পাশাপাশি অভিভাবকদেরও বই পড়ার উৎসাহিত করে যাচ্ছে। এতে সফলতার মুখ দেখছে বলে জানিয়েছেন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আজিজুল মুন্সি। বর্তমানে বইয়ের সংখ্যা এখন পাঁচ শতাধিক। নিয়মিত পাঠক সদস্য ১০০ ছাড়িয়ে গেছে। আর পত্রিকা পড়ার ভিড় লেগে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা মিলে পাঠাগারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে স্থানীয় ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে সংবর্ধনা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসও এরা যথাযথভাবে পালন করে আসছে। গ্রামের যুব শ্রেণীর শিল্প সাহিত্যের চর্চা বাড়াতে পাঠাগারের পক্ষ থেকে ‘পড়ুয়া’ নামে একটা সাহিত্য সংকলনও প্রকাশ করেছে ইতোমধ্যে।
কথা প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শামীম হোসেন বলেন, ‘আমাদের পাঠাগার নিয়ে স্বপ্ন অনেক, কিন্তু বাস্তবায়নে থেমে যাই অর্থের অভাবে। যখন আমরা পাঠাগারটি গড়ে তুলি তখন সবাই ছিলাম ছাত্র। অনেকেরই লেখাপড়া শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার অবিরাম চেষ্টা চলছে এখন। আমরা কর্মক্ষেত্রে যোগদান করার পর পাঠাগারটি পরিচালনায় আর সমস্যা থাকবে না।
আমরা চাই বই পড়ার মধ্য দিয়ে গ্রামকে আলোকিত করার অগ্রযাত্রায় সবাই এগিয়ে