শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

rubelকোন দেশ কতটা উন্নত জানতে হলে সে দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। যে দেশ শিক্ষা-দিক্ষায় যত উন্নত সে দেশের সামগ্রিকভাবে ততো উন্নয়ন হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলকে দেখলে বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করার পর বাংলাদেশের সমসাময়িক যে রাষ্ট্রগুলো ছিল যেমন- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, শ্রীলংকা প্রভৃতি শিক্ষা-দিক্ষায় এখন বাংলাদেশের চেয়ে অনেক দুর এগিয়ে গেছে। শিক্ষাব্যাবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপই এর একমাত্র কারন। আমরা কথায় যতটা দেখাই বাস্তবে ততটা করলে দেশের এই জীর্ণ দশা দেখতে হতনা। যে দেশে শিক্ষকদের পরিবারের ভরণপোষনের চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে চলতে হয় সে দেশে আর যাই হোক তাদের কাছ থেকে মান সম্পন্ন শিক্ষা আশা করাটা কি যৌক্তিক? কথাটি খুব সহজ হলেও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ব্যাপক।

শিক্ষকদের বেতনের জন্য, মর্যাদা রক্ষার জন্য যদি অনশন, আন্দোলন করতে হয়, রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে হয়, পুলিশের হাতে মার খেতে হয় তখন শিক্ষক সমাজের সামগ্রিক অবস্থা কেমন- এটা জানতে মাইক্রোস্কোপ এর দরকার পরে না।

শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর, জাতীর বিবেক, দুঃসময়ের কাণ্ডারি প্রভৃতি কত বিশেষণই না আমরা দিয়ে থাকি কিন্তু তাদের প্রাপ্য মর্যাদা কতটুকু আমরা দিয়ে থাকি? এমন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া খুব কঠিনই হবে যিনি তার পরিবারের ভরনপোষণের জন্য প্রতি মাসে না হোক দুই/তিন মাসে অপরের কাছে ধার/ দেনা করতে হয় না। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়) কমরত প্রতিটি শিক্ষকের অবস্থা কমবেশি একই। অথচ লেখাপড়ায় যারা ভাল, ভাল রেজাল্টধারী তারাই মূলত এই পেশায় আসে বা আসতে আগ্রহী থাকে জাতীর বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে। জাতীর মেধাবী সন্তানদের সাথে এটা কি প্রহসনমূলক আচরণ নয়?

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই (ধনী/ দরিদ্র) শিক্ষকগন সম্মানের পাত্র এবং তাদের জন্য বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়ে থাকে যাতে করে তারা দেশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে পারেন। আর আমাদের দেশেও শিক্ষকগন শ্রদ্ধার পাত্র তবে প্রায় প্রতিটি শিক্ষকেই তাদের পরিবার পরিচালনার জন্য এই পেশার পাশাপাশি আর একটি বা একাধিক পেশায় নিয়োজিত থাকতে হয়। এর ফলে দেশ ও জাতি তাদের কাছ থেকে কাংক্ষিত সেবা লাভ করতে পারে না বা সক্ষম হয় না। এ জন্য কি শিক্ষকদের দোষ দেয়া যায়? যখন দেশে মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড পরিমান হয়ে যায়, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়, সবাই আনন্দ-উল্লাস করে তখন অনেক শিক্ষকই পরিবার পরিচালনায় হিমশিম খেতে থাকেন।

প্রতিবার যখনই দেশে নতুন সরকার গঠিত হয় দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা ও এর সাথে সম্পর্কিত শিক্ষকদের নিয়ে অনেক অনেক আশার কথা আমরা শুনে থাকি কিন্তু বাস্তবায়ন আর হয় না অদৃশ্য কোন এক কারনে। আজকে যারা দেশের কাণ্ডারি, অনেক বড় বড় পদে অসিন হয়ে আছেন নিশ্চয়ই তারা তাদের শিক্ষকদের সমগ্রিক অবস্থা ভুলে যাননি, তবে কেন এত উদাসিনতা তাদের জন্য ভাল কিছু করতে। শিক্ষকরা তো ঘুষ খায় না, দুর্নীতি করে না, পেশি শক্তি দেখায় না, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় বলেই কি তাদের সব দিক থেকে এত বঞ্চিত হতে থাকতে হবে?

Post MIddle

অনেকেই বলে থাকেন যে দেশের শিক্ষার মান এখন নিম্নমানের- কথাটি সত্য, এর জন্য কি এককভাবে শিক্ষক সমাজ দায়ী? সরকার বা পরিপার্শ্বিক পরিবেশ কি দায়ী নয়? দেশের যেকোনো অঞ্চলের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একবার যেয়ে দেখে আসুন বিষয়টি সরেজমিনে। শিক্ষকদের বসার জায়গা নেই, ছাত্রছাত্রীদের বসার বেঞ্চের স্বল্পতা, লেখাপড়ার উপকরনের স্বল্পতা, ঘরের চালা দিয়ে বর্ষাকালে পানি পরে, সহায়ক উপকরনের স্বল্পতা প্রভৃতি নিত্যদিনের ঘটনা।

অনেক দিন ধরেই শুনে আসছি, শিক্ষকবৃন্দের জন্য আলাদা বেতন স্কেল দেবেন সরকার। গত ৯ মার্চ জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৪ উপলক্ষে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের মর্যাদা বাডানোর ঘোষণা দেন। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়- প্রায় ছয় বছর ধরে বলে আসছেন। আলাদা বেতন স্কেল দেব, দিচ্ছি। কিন্তু তিনি পারছেন না। শিক্ষকদের সম্মান না দেয়ার কারনে ও সুশিক্ষা না পাওয়ার কারনে আজ সমাজের যুব সম্প্রদায় যে অবস্হায় বিষক্রিয়া ছড়াচ্ছে তাতে সমাজকে অস্থির করে তুলছে। ধরুন, একজন ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছেন,ব্রেইন অপারেশন করবেন। রোগীর খুলি খুলে ফেলা হয়েছে। থকথকে মগজ বের হয়েছে। অস্ত্রোপচার চলছে। হঠাৎ তিনি আনমনা হয়ে গেলেন। অন্য কাজের কথা মনে পড়লো। পাঠক, একবার চিন্তা করুন রোগীর কী অবস্থা হবে? অশিক্ষা যদি আমাদের সামাজিক ব্যাধি হয়, এই রোগ সারাবেন একজন শিক্ষক। মা-বাবা মানব সন্তানের জন্ম দিয়ে এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখার ব্যবস্থা করে দেন ঠিকই। কিন্তু একজন শিক্ষক (যে কোন পর্যায়ের) মানব-শিশুর মধ্যে যে প্রতিভার বিকাশ ঘটান, তার সমস্ত বোধ দিয়ে, দর্শন দিয়ে নিজের ভেতরের জ্ঞানের সকল আলো শিষ্যের মধ্যে প্রতিস্থাপন করতে উদ্যত হয়েছেন। শিক্ষকরা এখন জীবনের টানাপোড়নে টিউশন বা কোচিং সেন্টারের উপর ঝুঁকে পড়েছেন। সংসার জীবনে হিমশিম খেয়েই তাকে এই কাজটি করতে হচ্ছে। সখ করে কেউ কি একাধিক পেশায় নিয়োজিত হন?

সরকার এবং সংস্লিস্থ সকলের কাছে আমার আহ্বান অন্যান্য জরুরী বিষয়গুলোর মতো শিক্ষকদের সার্বিক বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করুন। সমাজের সকল মানুষ যাদের কোন না কোন আত্মীয় শিক্ষা গ্রহন করছেন, তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, সমাজের কথা চিন্তা করে- শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা দেবার ব্যবস্থা করুন। কেননা, আজকের কর্ণধারগণের যোগ্যতা শিক্ষকজাতির জন্য, আমলাদের যোগ্যতা, ব্যাংকার, সামরিক বাহিনীসহ সকল স্তরের মানুষের যোগ্যতা কোন না কোন শিক্ষকের অবদান।

মোঃ রুহুল আমীন,

সহকারী অধ্যাপক,লোক প্রশাসন বিভাগ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা।

পছন্দের আরো পোস্ট