৬১ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রূপ নিয়েছে সহিংস ক্যাম্পাসে
আজ ৬ জুলাই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতি। সকাল ১০টা ৫মিনিটে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এবং পতাকা উত্তোলন ।এছাড়াও রয়েছে বেলুন, ফেস্টুন, কবুতর অবমুক্ত করণ। সকাল সোয়া ১০টায় বৃক্ষরোপণ, সকাল সাড়ে ১০টায় শোভাযাত্রা, সকাল ১১টায় সিনেট ভবনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতা, দলীয় ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, ক্যাম্পাসে সকল ছাত্রসংগঠনগুলোর সহঅবস্থান না থাকা ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কোন অতিথি না থাকার অভিযোগ তুলে এবারে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান থেকে নিজেদের বিরত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মুল্যবোধে বিশ্বাসী (সাদা দল)।
উত্তর বঙ্গে বাংলা ভাষা চর্চা ও শিক্ষার প্রসার ঘটাতে ১৯৫৩ সালের এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও সব ছাপিয়ে এখন তা রূপ নিয়েছে সহিংস ক্যাম্পাসে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখলেও ক্যাম্পাসে একের পর এক খুন, রগকাটা, হামলা, সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনা সব চেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে দেশের সর্বত্রই।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত তিন যুগে অন্তত ২৯ শিক্ষার্থী খুন হয়েছে এই ক্যাম্পাসে। এই সময়ে ক্যাম্পাসে রগকাটার স্বীকার হয়েছে অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী। এছাড়াও স্বাধীনতার পর থেকেই এই ক্যাম্পাসে হামলা, সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রতি বছরই এই ক্যাম্পাসে অন্তত ৫০টি সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনা ঘটছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ক্যাম্পাসে অন্তত ৩ হাজারেরও অধিক সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এতো ঘটনা ঘটলেও একটিরও বিচার হয়নি। প্রতিটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেছে নিরব। আর এ কারণেই দিন দিন এই ক্যাম্পাসটি সবার কাছে সহিংস রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। একাধিক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরাও এমনটাই মত দিয়েছেন।
রাজশাহীর প্রখ্যাত আইনজীবী মরহুম মাদারবখ্শ ও রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ইৎরাত হোসেন জুবেরীর অনন্য অবদানে গড়া এই ক্যাম্পাসটি শিক্ষাচর্চার জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও এখন সন্ত্রাস চর্চা হচ্ছে বলেই মনে করছেন একাধিক শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা হওয়ার কথা থাকলেও সে দিকে দৃষ্টি ঘুরাতে পারছে না এই ক্যাম্পাসটি। এই খাতে অপ্রতুল বাজেট ও নিয়ন্ত্রনহীত ছাত্ররাজনীতির কারণে দিন দিন সবার কাছে ভয়াবহ হয়ে উঠছে এই ক্যাম্পাসটি।
১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন পাকিস্তানি আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হাতে নিজের জীবনের বিনিময়ে ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে ড. শামসুজ্জোহা নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেও তারঁ রক্তে ভেজা ক্যাম্পাসে এখন কোনো হত্যাকান্ডেরই বিচার হচ্ছে না। তাছাড়া ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুমসহ অনেক ছাত্র ও কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিলেও তাদের আত্মত্যাগের এই ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীই আজ নিরাপদ নয়।
১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে ৭টি বিভাগে (দর্শন, ইতিহাস, বাংলা, ইংরেজী, অর্থনীতি, গণিত ও আইন) ১৬১ শিক্ষার্থী নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদের অধীনে ৫০টি বিভাগে পড়াশুনা করছেন অন্তত ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন ১২ শতাধিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারি রয়েছেন প্রায় ৩ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য ১৬টি আবাসিক হলসহ গবেষকদের জন্য রয়েছে একটি ডরমেটরি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৩৭ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মধ্যে সরকারি ১৭টি, বেসরকারি ২০টি। রয়েছে ৫টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট।
তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ ও অনুষদ বাড়লেও বাড়েনি পড়াশুনার মান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে একাধিকবার অভিযোগ তুললেও তা কানে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১০ গাজার ছাত্রীর জন্য ৫টি আবাসিক হল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হলেও গত তিন বছরেও নির্মানকাজ শেষ হয়নি শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের থেকে প্রতিবছর অর্থ নিয়েও ইন্টারনেট সেবা দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে নামে মাত্র রাখা হয়েছে ওয়াইফাই (তারবিহীন ইন্টানেট) ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের থেকে দুই বছর ধরে ৪০০ টাকা করে নিয়েও দেয়া হয়নি ডিজিটাল পরিপয়পত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে খাবারের মান নিয়েও অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। টাকার বাড়ালেও হল কর্তৃপক্ষ বাড়ায়নি খাবারের মান। তাই বাধ্য হয়ে অস্বাস্থকর ও নি¤œমানের খাবার খেয়েই পড়াশুনা করছেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের জন্য শহীদ মীর আব্দুল কাউয়ূম ইন্টারন্যাশনাল ডরমেটরি নামে একটি দ্বি-তল আবাসিক ভবন থাকলেও তার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন গবেষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য ৫টি ইনস্টিটিউটের মধ্যে আইবিএস ও আইবিএ-তে গবেষণা হলেও ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, পরিবেশ বিজ্ঞান এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা হচ্ছে না। নামে মাত্র ইনস্টিটিউটগুলো চালু রাখা হয়েছে।
তমাল/স:আরএইচ